বিএম ডিপোতে পুড়েছে ২৫০ কোটি টাকার রফতানি পণ্য
৬ এপ্রিল ২০২৩ ২২:১০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১০ মাস আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ২৫০ কোটি টাকার রফতানি পণ্য পুড়ে যাওয়ার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাস্টমসের গঠন করা কমিটি। এর মধ্যে অধিকাংশই তৈরি পোশাক, যা রফতানির উদ্দেশ্যে জাহাজে নেওয়ার জন্য ডিপোতে অপেক্ষমাণ ছিল। কমিটির সদস্যরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ও অক্ষত- এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে রফতানি পণ্যের ক্ষয়ক্ষতির একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছে কমিটি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনারকে দেওয়া হবে। এরপর প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হবে বলে কমিটির কর্মকর্তারা জানান।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপ-কমিশনার ব্যারিস্টার বদরুজ্জামান মুন্সি বলেন, ‘বিএম ডিপো কনটেইনার লিমিটেডে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাস্টমসের পক্ষ থেকে একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি তিন ক্যাটাগরিতে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের তালিকা করে অর্থমূল্য নির্ধারণ করেছে। এটা করা হয়েছে এই জন্য যে, ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে আর্থিক সুবিধা পেতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা অন্য কোনো অর্গানাইজেশনের কাছ থেকে।’
তবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ হলেও আদৌ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে কিনা বা কারা ক্ষতিপূরণ দেবে- এ নিয়ে কোনো তথ্য নেই কমিটি এবং ডিপো কর্তৃপক্ষের। ডিপোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রফতানি পণ্যের বাইরে তাদের আরও প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
গত বছরের ৪ জুন দিবাগত রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। এরপর সেখানে কয়েক দফা বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যুর খবর প্রশাসন নিশ্চিত করে, যাদের মধ্যে আটজনের পরিচয় এখনও মেলেনি। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১০৭ জন। হতাহতদের অধিকাংশই ডিপো শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, ফায়ার সার্ভিসকর্মী, বিভিন্ন ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের চালক, হেলপার ও পুলিশ সদস্য।
এ ঘটনায় রফতানি পণ্যের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে গত বছরের ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দফায় দফায় ডিপো পরিদর্শন এবং বিভিন্ন সংস্থার নথিপত্র পর্যালোচনায় কমিটি জানতে পারে, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ডিপোতে রক্ষিত কিছু কনটেইনার সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক পুড়ে যায়। কিছু কনটেইনার অবশ্য আগুনের মধ্যেও সুরক্ষিত ছিল। কিছু পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যান ওই রাতেই বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে, ডিপোর সিএফএস-১ শেডে রক্ষিত সব পণ্য পুড়ে যায় এবং দুই নম্বর শেডে পণ্য অক্ষত ছিল। সেই অক্ষত পণ্যের মধ্যে কিছু অংশ পরবর্তী সময়ে রফতানি করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ পণ্য জানুয়ারিতেও মজুত ছিল। যেসব কনটেইনার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর ভেতরে কিছু পণ্য সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরও কিছু পণ্য অক্ষত থাকলেও ধোঁয়ার গন্ধ থাকায় সেগুলো রফতানি অযোগ্য বলে মনে করছেন কমিটির সদস্যরা।
সূত্র মতে, খসড়া প্রতিবেদনে সিএফএস-১ শেডে ৮১৯টি জাহাজীকরণ নথির বিপরীতে এক লাখ ২৬ হাজার ৬২৪টি রফতানি কার্টন সম্পূর্ণরূপে পুড়ে গেছে, যাতে এক কোটি ৭ লাখ ৭৮ হাজার ১০৩ মার্কিন ডলারের পণ্য ছিল। যেসব কনটেইনার আগুনে সম্পূর্ণরূপে পুড়ে গেছে, সেগুলোতে ৪১৩টি জাহাজীকরণ নথির বিপরীতে এক লাখ ৫ হাজার ৭৬৮টি কার্টন পুড়ে ৭৮ লাখ ১৫ হাজার ৫১৭ মার্কিন ডলারের পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কনটেইনারগুলোতে ৩৮টি জাহাজীকরণ নথির বিপরীতে ১০ হাজার ৭৮৫টি কার্টন পুড়ে ৭ লাখ ৭০ হাজার ৮৪২ ডলারের পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খসড়া প্রতিবেদনে ক্ষতিগ্রস্ত রফতানি পণ্যের মোট দাম এক কোটি ৯৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪৬৮ মার্কিন ডলার উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০০ কোটি টাকারও বেশি।
কমিটির অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন শিকদার বিপ্লব সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে যে রফতানি কার্গোগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমরা সরেজমিন তদন্ত করে একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এতে আমরা উল্লেখ করেছি, প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার রফতানি পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই তৈরি পোশাক।’
সূত্র মতে, রফতানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোওয়ার্ডার এবং কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যার থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা এই খসড়া প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার সময় সিএফএস-২ শেডে ১৪০টি জাহাজীকরণ নথির বিপরীতে মজুত রাখা ৬৩ হাজার ৯২৭ কার্টনে ৬২ লাখ ৩২ হাজার ১৭১ মার্কিন ডলারের পণ্য অক্ষত পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই প্রতিবেদনে অক্ষত কনটেইনারে ১০২০টি জাহাজীকরণ নথির বিপরীতে তিন লাখ ৬৪ হাজার ৬২৬ কার্টনে ২ কোটি ২৪ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪২ মার্কিন ডলারের রফতানি পণ্য এবং ২৫৯টি জাহাজীকরণ নথির বিপরীতে ১৩ হাজার ৪৭ কার্টনে ২৬ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলারের পণ্য নিয়ে কাভার্ড ভ্যান নিরাপদে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী সরকারিভাবে নিরূপণ করা রফতানি পণ্যের ক্ষতিপূরণ ডিপো মালিককে দিতে হবে। তবে ডিপো কর্তৃপক্ষ বলছে, টানা তিনদিনের আগুনে রফতানি পণ্যের বাইরে তাদের নিজস্ব যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এ ক্ষতিপূরণ কে দেবে ?
বিএম কনটেইনার ডিপোর উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নুরুল আকতার সারাবাংলাকে জানান, আগুনে ডিপোর নিজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। হতাহতদের ক্ষতিপূরণ বাবদ তাদের দিতে হয়েছে আরও ৪০ কোটি টাকা।
একই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক মইনুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গাড়ি, ট্রেইলর, ক্রেনসহ বিভিন্ন ইক্যুইপমেন্ট পুড়ে গেছে। কনটেইনার পুড়ে গেছে। অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ক্ষতির পরিমাণ ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা। এই ভয়াবহ ঘটনা কেন ঘটল, সেটার জন্য কোনো তদন্ত কমিটি এককভাবে বিএম কনটেইনারকে দায়ী করেনি। তাহলে বিএম ডিপোর ওপর এককভাবে দায় চাপানোর সুযোগ নেই। আমি নিজেই যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত, আমার ক্ষতিপূরণ কে দেবে ? আমার তো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ নেই।’
উল্লেখ্য, স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন ২৪ একর জায়গার উপর নির্মিত বিএম ডিপো সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রায় ৬০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। আমদানি কনটেইনার ও খালি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ২২ হাজার ও ৪০ হাজার টিইইউএস।
দুর্ঘটনার চার মাসের মাথায় গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বিএম কনটেইনার ডিপোটি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন আঙ্গিকে সংস্কারের কাজ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম