Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকার ৩০ মার্কেট ঝুঁকিতে

রাজনীন ফারাজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৫

ঢাকা: রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ শপিং মল ও মার্কেট কমবেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ তালিকায় যেমন সিটি করপোরেশনের মার্কেট রয়েছে, তেমন রয়েছে বেসরকারি মার্কেটও। অল্প জায়গায় বেশি দোকান তৈরি, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব আর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাতো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই শুরু হয় হৈচৈ। সময়ের ব্যবধানে থেমে যায় সব। কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না কেউ। রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন যার বড় উদাহরণ।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেটকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ড

শুধু তাই নয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পর ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তারপরও ব্যবসায়ীরা কোনো রকম ব্যবস্থা না নিয়েই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর বেশিরভাগ শপিংমল ও মার্কেটগুলো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকায় যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটির মালিকানাধীন মার্কেটগুলোর মধ্যে আরও অন্তত ৩০টি শপিং মল ও মার্কেট বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১টি মার্কেট আর উত্তরে ১৯টি।

এসব মার্কেট ভবন তৈরির সময়কাল ও নির্মাণ, ইউটিলিটি লাইনের সংযোগ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভবন ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে ও কিছু ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মালিকানাধীন ৪৩টি মার্কেটের মধ্যে ১৯টি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলো হল- খিলগাঁও তালতলা সুপার মার্কেট (৬৩৭ টি দোকান), গুলশান (উঃ) পাকা মার্কেট (৬০ টি দোকান), গুলশান (উঃ) কাঁচা মার্কেট (৩০৩ টি দোকান), গুলশান-১ (দঃ) পাকা মার্কেট (২৪২ টি দোকান), গুলশান-১ (দঃ) কাঁচা মার্কেট (২৯১), গাবতলীর প্রান্তিক সুপার মার্কেট (৭৯ টি দোকান), মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজার ১ম ও ২য় তলা (৪৮৭ টি দোকান), মোহাম্মদপুর টাউন হল মিলনায়তন কাম শপিং কমপ্লেক্স মার্কেট (৮৯ টি দোকান), মোহাম্মদপুর রিং রোড টিন সেড মার্কেট (১৫ টি দোকান), মোহাম্মদপুর রিং রোড পাকা মার্কেট (৬৭ টি দোকান), কাওরান বাজার ১নং ভবন মার্কেট (২৪৬ টি দোকান), কাওরান বাজার ২ নং ভবন মার্কেট (৩৪০ টি দোকান), কাওরান বাজার মুরগি সেড (২৪ টি দোকান), কাওরান বাজার মৎস আড়ৎ (অস্থায়ী) (১৬ টি দোকান), কাওরান বাজার কর্মকার সেড (১২ টি দোকান), কাওরান বাজার কাঁচা মার্কেট (কিচেন মার্কেট) (৮১৪ টি দোকান), কাওরান বাজার কাঁচা মালের আড়ৎ মার্কেট (১৭৬ টি দোকান), কাওরান বাজার কাঁচা মার্কেটের চতুর দিক মার্কেট (১২১ টি দোকান), কলমিলতা কাঁচা মার্কেট (১৩৩ টি দোকান)। এই ১৯টি মার্কেটের মোট চার হাজার ১৫২ টি দোকান ঝুঁকিতে আছে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী সেলিম রেজা বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে এগুলো ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। তারা আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এসব ভবন ভাঙার কাজ শুরু করবেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। তারাই বিভিন্ন ভবন অ্যাসেস করে সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা নির্ধারণ করেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ঢাকায় যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে সেগুলো হঠাৎ ভেঙে পড়া ও আগুন লাগার ঝুঁকিতেও রয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পাঁচটি অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে রয়েছে মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, ফুটওভার ব্রিজ, বাজারসহ অন্যান্য ভবন। এর মধ্যে মার্কেট ও মার্কেট কমপ্লেক্স ১১টি। এদের মধ্যে কিছু মার্কেট ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে ও কিছু স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ সম্বলিত লাল সাইনবোর্ড দৃশ্যমান স্থানে লাগানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হকার্স মার্কেট, ঢাকেশ্বরী মার্কেট, নিমতলী মার্কেট, কাপ্তান বাজার রোড সাইড মার্কেট ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে ও ২ নং পলাশী মার্কেটেরর ঝুঁকিপূর্ণ অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঢাকেশ্বরী মার্কেটের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

অন্যদিকে, সিদ্ধেশ্বরীর নিউ সার্কুলার রোডের লিলি প্লাজা মার্কেট ভবন, আজিমপুর কবরস্থান মার্কেট, আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, নিমতলী মার্কেট, দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ড রোডসাইড মার্কেট, ঠাটারি বাজার মার্কেট ও নওয়াব ইউসুফ মার্কেট কমপ্লেক্সে দৃশ্যমান স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ সম্বলিত লাল সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত কাওরান বাজার কাঁচা মার্কেটের (কিচেন মার্কেট) সভাপতি মো. লোকমান হোসেন বলেন, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় ২০০৯ সালে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী দল ও বুয়েটের প্রকৌশলী দলের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ঢাকার বেশ কয়েকটি মার্কেটে সার্ভে করে। বুয়েটের শিক্ষক আ ফ ম সাইফুল আমিনের নেতৃত্বে এই সার্ভে দল তিন থেকে চারটি মার্কেটকে রেট্রোফিটিং কারিগরি পদ্ধতিতে ভবন ঝুঁকিমুক্ত করার পরামর্শ দেন। এতে ভবনগুলো ৫০ থেকে ৬০ বছর নিরাপদ থাকবে। সেই নির্দেশনার সিটি করপোরেশন আজ পর্যন্ত এক টাকারও কাজ করেনি।

তিনি বলেন, কিচেন মার্কেটে ১২ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করার কথা কিন্তু তিনতলা পর্যন্ত করে ফেলে রাখছে। ৮৪ সালে কাজ ধরে ৮৬ সালে এই ভবন আমাদের হাতে দেয়। এতে ভবনের বয়স হয় ৩৬ বছর। একটি ভবনের বয়স থাকে ৯৯ বছর সেখানে ৩৬ বছরেই একটা ভবন কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয় বুঝি না আমি। আর পরিত্যক্ত হলেও সেটার অবহেলা ও দায়-দায়িত্ব কার সেটাও আমার প্রশ্ন।

তিনি আরও বলেন, অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর সিটি করপোরেশন তিন কোটি ৩৪ লাখ ৮৩৫ টাকার রেট্রোফিটিং করার টেন্ডার দেয়। আজিজ গ্রুপ এই টেন্ডার পায় কিন্তু কে বা কার কথায় এই কাজ বন্ধ আছে। এটি সিটি করপোরেশনের অবহেলা ছাড়া আর কিছু না।

এই মার্কেটে তারা কোনো ঝুঁকি অনুভব করেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, এখন পর্যন্ত যতবার ভূমিকম্প হয়েছে আমাদের কিছুই হয়নি। আমাদের ভবনে অবকাঠামোগত কোনো ঝুঁকি আছে বলে মনে করি না। আর আমাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আংশিক হলেও পর্যাপ্ত পানি রয়েছে। মার্কেটের ছাদে ও বাইরে পানির রিজার্ভ আছে। এছাড়া অন্যান্য ফ্লোরেও পানির ট্যাংকি আছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মাহমুদ খান বলেন, একটি ভবন যেসব কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয় তার মধ্যে রয়েছে ভবন অনেক পুরাতন হয়ে যাওয়া, আগুন লাগলে ভবন থেকে বের হতে না পারা বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনে সহজে ঢুকতে না পারা, বিভিন্ন ইউটিলিটি লাইন ত্রুটিপূর্ণ হওয়া এবং অগ্নি নির্বাপণের উপযুক্ত ব্যবস্থা বা ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকা ইত্যাদি। এছাড়াও ভবনগুলোতে অন্তত তিন মাস পরপর সুয়ারেজ লাইন চেক করা উচিৎ কিন্তু তা আমাদের দেশে করা হয় না, ফলে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঝুঁকিতেও থাকে অনেক ভবন।

রাজধানীতে গত কয়েকদিনে বেশ বড় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনায় পানিসংকটের বিষয়টি সামনে আসে। এর আগে গুলশানে আবাসিক ভবনে হাতিরঝিল থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করা হয়।

সম্প্রতি বঙ্গবাজারে আগুন লাগলে খুব কাছেই কাজী আলাউদ্দীন রোডে ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার থাকা  স্বত্বেও আগুন নেভাতে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে।

ভোর ৬টা ১০ মিনিটে লাগা আগুন ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জ্বলে। যখন আগুন নেভানো হয় ততক্ষণে সব পুড়ে ছারখার।

আগুন দ্রুততম সময়ে নেভাতে না পারার জন্য ফায়ার সার্ভিস তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে প্রথম কারণটি ছিলো পানির উৎস না থাকা।

ঘটনার দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হলের পুকুর থেকে পানি এনে কাজ করে তারা। এতেও সংকুলান না হওয়ায় বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরের হাতিরঝিল থেকে হেলিকপ্টারে করে পানি এনে ছেঁটানো হয়।

হাতিরঝিল থেকে পানি নিচ্ছে হেলিকপ্টার

আদিল মাহমুদ খান বলেন, নগর পরিকল্পনা করার সময় নাগিরকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে মাথায় রাখতে হবে। আমরা জলাভূমি ভরাট করে ফেলেছি। আবার বিশ্বের অন্যান্য শহরের মত ঢাকায় পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্রেন্টও নাই। ফলে রাজধানীর যেকোন জায়গায় আগুন লাগলে পানির সংকটে আগুন নেভাতে বেগ পোহাতে হয়।

ওয়াসা এমডি তাকসিম এ খান বলেন, প্রতিটি বিল্ডিং বানানোর সময় সেখানে অগ্নি নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। শুধুমাত্র ফায়ার হাইড্রেন্ট না, ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকতে হবে। আমাদের শহরের রাস্তাঘাট যেহেতু পুরনো তাই শহরের মধ্যে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা নেই।

তিনি বলেন, ঢাকায় ৯০০টি পাম্প স্টেশন আছে। দমকলবাহিনী অগ্নিনির্বাপণে সেখান থেকে পানি নেয়। সম্প্রতি বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের সময় আমরা ১৮০ ট্রাক পানি দিয়েছি। ঢাকা ওয়াসার ১৫০ জন কর্মীও ছিল সেখানে। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। একটি শহরে আরও জলাশয় থাকতে হবে। একা ওয়াসা তো এটা করতে পারবে না। শুধু আগুন নির্বাপণের জন্যই নয়, পরিবেশ ঠিক রাখতেও আমাদের আরও জলাশয় থাকতে হবে।

নতুন বাসভবন বা মার্কেট ভবনে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে ওয়াসা থেকে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা হবে বলে।

ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মাহমুদ বলেন, প্রতিটা অগ্নি দুর্ঘটনার সময় দেখা যায় অগ্নি নিরাপত্তাকর্মীরা জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু তাদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় না।

তিনি বলেন, ঢাকার মত ঘনবসতি ও অপরিকল্পিত নগরীতে যানজট, সরু রাস্তার জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঠিকমত জায়গামত পৌঁছাতে পারে না। এই শহরের উপযোগী ফায়ার সার্ভিসের বিষয়টিও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। এর জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতির দরকার হলে দিতে হবে।

সারাবাংলা/আরএফ/এনইউ

কাওরান বাজার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপেরেশন নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মাহমুদ খান বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন রাজধানী সিটি করপোরেশন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

বাংলাদেশ-ভারত টেস্টে হামলার হুমকি!
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩৫

সম্পর্কিত খবর