সারের পেছনে কৃষকের বাড়তি খরচ ৩ হাজার কোটি টাকা
১১ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:১৮
ঢাকা: দেশে প্রধান চারটি সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে দেশে উৎপাদন খরচ বাড়বে কৃষিপণ্যের। আগামী অর্থবছরে কৃষককে চারটি সার কিনতেই বাড়তি গুণতে হবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এর প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপরও। দেশে বেড়ে যেতে পারে ধান ও চালসহ প্রায় সব কৃষি পণ্যের দাম। চলতি বোরো মৌসুমে এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ধান উঠতে শুরু করেছে। দেশে এখন আর কোথাও বোরো ধান উৎপাদনে সেই অর্থে সারের ব্যবহার হবে না। তবে সারের দাম বৃদ্ধির কারণে বোরো মৌসুমের ধান উঠার সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই আরও ১৫ দিন পরে সারের দাম বাড়ানো যেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষক এই মুহূর্তে যতটা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভোক্তারা। সারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বাজারে ধান ও চালের দাম বাড়ানো হবে। যদিও এই মুহূর্তে বোরোর উৎপাদন প্রায় শেষ দিকে। বিভিন্ন জায়গায় বোরো উঠা শুরু করেছে। তাই সারের দাম অন্তত আরও ১৫ দিন পরে বাড়ানো উচিৎ ছিল।’
তিনি বলেন, ‘সারের দাম বাড়ানো একেবারে অযৌক্তিক তা আমি বলব না। তবে সারের দাম বৃদ্ধির আগে আলাপ আলোচনা করার দরকার ছিল। টেকনিক্যাল নলেজ নেওয়া দরকার ছিল। দাম বৃদ্ধির কাউন্টার পার্ট হিসাবে করণীয় কী হবে তাও নির্ধারণ করা উচিৎ ছিল। দাম বৃদ্ধির ফলে ক্ষতি পোষাতে কী করা হবে তা নিরুপণ করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সারের ভর্তুকি কমানো উচিৎ বলে মনে করি। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোয় কি ব্যবস্থা নিয়েছে তা ভাবতে হবে। ভাবনা চিন্তা করে দাম বাড়ানো উচিৎ। কিন্তু সরকার তা কতোটা করেছে তা কিন্তু আমরা জানি না।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে বোরো ধান প্রায় পেকে গেছে। অনেক জায়গায় কাটাও শুরু হয়েছে। ফলে বোরো উৎপাদনে সারের দাম বৃদ্ধির কোনো প্রভাব পড়বে না। আসছে আউশ মৌসুমে ও পাট উৎপাদনে প্রচুর সারের প্রয়োজন হয়। সেখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরবর্তীতে আমন মৌসুমেও সারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘সারের দাম পর পর দুইবার বাড়ানো হয়েছে। বিশ্বব্যাপীই সারের দাম বেশি। আবার বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনও কমে গেছে। খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও বলা হচ্ছে এক ইঞ্জি জমি পতিত না রাখার কথা। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদনের প্রধান উপকরণ সারের দাম বৃদ্ধি অনেকটা সাংঘর্ষিক। দেশে বারবার ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে কৃষক তার উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে। কারণ উৎপাদনে কৃষকের খরচ তো বেড়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সামনে বাজেট রয়েছে। বাজেটে কৃষকদের নগদ সহায়তা দিতে হবে। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তাও নিশ্চিত করতে হবে।’
সারের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার এরইমধ্যে সারের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিকেজিতে ৫ টাকা করে বাড়িয়েছে। আমরা খুব চেষ্টা করেছি সারের দাম না বাড়াতে। সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে সারের দাম যেন না বাড়ানো হয়। সারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। প্রতেকটি সারের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, ‘গতবছর সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, এবার ৪৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এটি সরকার দিতে পারছে না। দিতে কষ্ট হচ্ছে। অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্যই সরকার বাধ্য হয়েছে সারের দাম বাড়াতে। কৃষকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে পরিমাণ দাম বেড়েছে তাতে উৎপাদনে খুব একটা প্রভাব পড়বে না।’
প্রসঙ্গত ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কৃষকপর্যায়ে প্রতিকেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।
একইভাবে, ডিলার পর্যায়েও প্রতিকেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা, ডিএপি ১৪ টাকার পরিবর্তে ১৯ টাকা, টিএসপি ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা এবং এমওপি ১৩ টাকার পরিবর্তে ১৮ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ১০ এপ্রিলের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় সোমবার (১০ এপ্রিল) সারের মূল্য বৃদ্ধির এই আদেশ জারি করেছে।
এতে বলা হয়, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সারের আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সারের মূল্য পুনঃনির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পুনঃনির্ধারিত এ মূল্য ১০ এপ্রিল থেকেই কার্যকর হয়েছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিকেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা আর এমওপি ৬০ টাকা। এর ফলে ৫ টাকা দাম বৃদ্ধির পরও সরকারকে প্রতিকেজি ইউরিয়াতে ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। বিগত তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় ৩ থেকে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশে সারে প্রদত্ত সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ।
২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ভর্তুকিতে লেগেছিল ৭ হাজার ৪২০ কোটি টাকা; সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রয়োজন হবে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সারে ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এখন পর্যন্ত সর্বমোট এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে।
হিসাব করে দেখা গেছে, যে চারটি সারের দাম বাড়ানো হয়েছে সেই সারের চাহিদা ধরা হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ টন। ফলে আগামী অর্থ বছরে শুধু এ চারটি সার কিনতে কৃষককের বাড়তি গুনতে হবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টন সারের চাহিদা নির্ধারণ করেছে সরকার। এরমধ্যে আগামী অর্থবছরে ২৭ লাখ টন ইউরিয়া, ১৬ লাখ টন ডিএপি, সাড়ে ৭ লাখ টন টিএসপি, ৯ লাখ টন এমওপি, ৩০ হাজার টন এমওপি, ৩০ হাজার টন এনপিকেএস, সাড়ে ৫ লাখ টন জিপসাম, এক লাখ ৪০ হাজার টন জিংক সালফেট, ২ হাজার ৫০০ টন অ্যামোনিয়াম সালফেট, ৯০ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম সালফেট এবং ৫০ হাজার টন বোরন প্রয়োজন হবে সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে কৃষিমন্ত্রণালয়। এই তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে চারটি সারের দাম বাড়ানো হয়েছে তার চাহিদা ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টন। সে হিসাবে কৃষককে বাড়তি খরচ করতে হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে