জৌলুস হারিয়েছে হালখাতা
১২ এপ্রিল ২০২৩ ১১:০৮
ঢাকা: বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি হালখাতা জৌলুস হারিয়েছে। আগের মতো জমজমাটভাবে আর পালিত হয় না হালখাতা উৎসব। টালিখাতার বিক্রিও নেই আগের মতো। অ্যাপস আর সফটওয়্যারের প্রচলনে টালিখাতা বিলুপ্তপ্রায়।
কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় টালিখাতার বিক্র চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। করোনা ও রোজার প্রভাবেও জমে উঠছে না হালখাতা।
পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের একাধিক জুয়েলারি দোকান ঘুরে জানা গেছে, এরইমধ্যে তারা দোকান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের কাজ শেষ করেছেন। যারা এখনও দোকান পরিষ্কার করেননি, তারা দুই-একদিনের মধ্যে তা করে নেবেন। বৈশাখের প্রথম দিনে দোকান সাজানো হবে ফুল দিয়ে। পুরনো খাতার বদলে দোকানে উঠবে নতুন খাতা। নতুন করে হিসাব সাজানো হবে নতুন বছরের। প্রথম দিনে নিয়মিত ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে। সঙ্গে থাকবে ছোটখাটো উপহার সামগ্রীও। তবে রোজার দিনে এবার বৈশাখ হওয়ায় হালখাতা আর আগের মতো জমজমাট হবে না।
তাঁতিবাজারে ৪০ বছর ধরে ফেরি করে টালিখাতা বিক্রি করেন সিদ্দিক মিয়া। কয়েকটি জুয়েলারি দোকানের সামনে পাওয়া যায় তাকে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে ফেরি করে এখানে টালিখাতা বিক্রি করি। অনেকেই আমার কাছ থেকে টালিখাতা কেনেন। বেচাকেনা ভালোই হয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ৪০ বছর আগে এতো দোকান ছিল না। বিক্রিও এতো বেশি ছিল না। এখন বিক্রি বেশি। তবে টালিখাতার বিক্রি গত কয়েকবছরে অনেক বেশি কমেছে।
তাঁতিবাজারে সি ঘোষ জুয়েলার্সের কর্মচারী সম্বোনাথ ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, এখন ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। আবার নানা জায়গায় নানা ধরণের দুর্ঘটনা ঘটছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বর্ণের দামও অনেক বেশি। দাম বেশি থাকায় স্বর্ণ এখন মানুষের নাগালের বাইরে।
তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ এবার রমজানে। ফলে দোকানে কেউ যদি আসে তাহলে তাদের অ্যাপায়ন করা হবে। দোকান এরইমধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। নতুন বছরে নতুন খাতা খোলা হবে। পঞ্জিকা অনুযায়ী শনিবার এখানে হালখাতা অনুষ্ঠিত হবে। হালখাতার দিন দোকানের কাস্টমারদের মিষ্টমুখ করানো হবে। গত কয়েক বছর ধরে হালখাতা আর জমজমাট হচ্ছে না। হালখাতা উপলক্ষে নিয়মিত ক্রেতাদের আমরা চাবির রিং, ঘড়ি, পার্স, ক্যালেন্ডার দিয়ে থাকি।
অঞ্জলি জুয়েলার্সের কর্মচারী অনিক সাহা সারাবাংলাকে বলেন, হালখাতা এবার বেশি ভালো হবে না। এবার বেচাকেনা কম। বঙ্গবাজার পুড়ে গেছে। সেকারণেও ক্রেতা কম। গত কয়েক বছর ধরে হালখাতায় এখন আর জৌলুস নেই। দাম বাড়াতে আরও বেচাকেনা কম। পঞ্জিকা অনুযায়ী হালখাতা শনিবারেই হবে। দোকান ফুল দিয়ে সাজানো হবে। এরইমধ্যে দোকান পরিষ্কার করা হয়েছে। সেদিনই নতুন খাতা খোলা হবে।
তাঁতিবাজারের শরীফ জুয়েলার্সের মালিক হাজী ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, রমজানের কারণে গত দুই বছর হালখাতা করতে পারিনি। করোনার কারণেও হালখাতা করা হয়নি। হয়তো আগামী বছর আমরা করতে পারব। তাঁতিবাজারে আমরা যারা মুসলমান রয়েছি তারাই শুধু হালখাতা করছি না। করোনার কারণে দুই বছর করতে পারিনি। গতবছর বৈশাখে রোজা ছিল। তাই গতবছরও করা হয়নি।
এদিকে বাবুবাজার ঘুরে দেখা গেছে, টালিখাতার বিক্রি অনেকটাই কমে গেছে। দোকানগুলোতে নেই ক্রেতাদের ভিড়। কথা হলে বাবুবাজারের শরিফ প্রোডাক্টসের মালিক মনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, হালখাতায় ব্যবহৃত টালিখাতার বিক্রি অনেক কম। খাতার দাম অনেক বেশি। আগে ৬ দিস্তার অফসেট টালিখাতার দাম ছিল ২৬৬ টাকা, সেই খাতার দাম এখন ৪২০ টাকা। কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। খাতা বিক্রি করে এখন আমাদের কোনো লাভ থাকে না।
তিনি বলেন, আগে প্রচুর বিক্রি হতো। দিনে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার টালি খাতা বিক্রি করতে পারতাম। এখন মাঝেমধ্যে কোনো কোনো দিনে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা বিক্রি করতে কষ্ট হয়। চৈত্র মাসেই এইসব খাতা বিক্রি হয়ে থাকে। সারা বছর খুব একটা বিক্রি হয়না। টালি খাতা কেনার সিজনই এখন।
অপর এক দোকান আলমগীর প্রোডাক্টসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, এখানে ১০ থেকে ১২ বছর ধরে ব্যবসা করি। এক সময় প্রচুর বিক্রি ছিল। টালিখাতার অনেক চাহিদা ছিল। এখন আর আগের মতো চাহিদা নেই। কাগজের দাম অতিরিক্ত বাড়ায় এখন আর মানুষ হালখাতাও করতে চায় না। মানুষ হালখাতার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
তিনি বলেন, যখন ১০ বছর আগে ব্যবসা শুরু করেছিলাম চৈত্রের শেষ দিকে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বিক্রি হতো। এখন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বিক্রি করতেও কষ্ট হয়। এখনও মফস্বল ও ঢাকার ব্যবসায়ীরা টালিখাতা ব্যবহার করেন। তবে এখন অনেকেই টালিখাতা জাতীয় অ্যাপস ব্যবহার করেন। কেউ কেউ সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। ফলে টালিখাতার প্রচলন আগের চেয়ে কমছে।
জেনারেল পেপারসের মালিক আসাদ খান সারাবাংলাকে বলেন, কম্পিউটার ও সফটওয়্যারের যুগ শুরু হওয়ার পরে এখন আর হালখাতার জৌলুস নেই। টালিখাতার ব্যবসা একেবারেই কমে গেছে। আগের তুলনায় বিক্রি চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
ছবি: সুমিত আহমেদ
সারাবাংলা/ইএইচটি/আইই