‘১০৮ পদে’ তৈরি পাচন খাবে বাঙালি, সবজি বিক্রির ধুম
১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চৈত্র সংক্রান্তিতে নিরামিষ পাচন রান্না বাঙালি পরিবারের দীর্ঘদিনের আচার। গ্রাম বাংলায় উৎপাদিত রকমারি সবজি, শাক, কাঁচা কাঁঠাল, শিমের শুকনো বীজ, হরেক রকমের ডাল দিয়ে রান্না হয় এই পাচন, যার মধ্যে টক, ঝাল, নোনতা, মিষ্টি, তেতো সব রকম স্বাদের মিশেল থাকে।
এক সময় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ঘরে ঘরে রান্না হতো এই পাচন। তবে কালক্রমে নিরামিষ পাচন খাওয়ার রেওয়াজ বাঙালি হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়েছে। আর নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাহাড়ের বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে চলে পাচন খাওয়ার উৎসব। প্রচলিত আছে, এই পাচন রান্না করতে হয় ১০৮ ধরনের সবজি দিয়ে। এ জন্য আঞ্চলিক ভাষায় ‘আঠোরা’ও বলা হয়।
পহেলা বৈশাখের আগেরদিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষদিনে পাচন রান্না হয় ঘরে ঘরে। বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তি হিসেব করে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়। কিন্তু বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ সরকারিভাবে নির্ধারিত আছে ১৪ এপ্রিল। বাংলাদেশে বসবাসরত সকল বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এদিনেই পহেলা বৈশাখ পালন করেন। হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন একদিন পরে আবার নববর্ষের ধর্মীয় আচারও পালন করেন।
দিনের গরমিল যা-ই থাকুক, প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির অন্তঃত দুইদিন আগ থেকে চট্টগ্রামের কাঁচাবাজারগুলোতে পাচনের সবজি বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম নেই। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে অনেকেই দু’দিন ধরে সংগ্রহ করছেন পাচনের সবজি। অনেক পরিবারে আজ (বৃহস্পতিবার) চৈত্র সংক্রান্তি হিসেব করে পাচন রান্না হয়েছে।
বকশিরহাট বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. সিয়াম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার আব্বা অনেকবছর এখানে সবজি বিক্রি করেছেন। এটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আগে চৈত্র সংক্রান্তির পাচন একদিন রান্না হতো। এখন দুইদিন রান্না হয়। সাধারণত মুসলিম পরিবারে ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তি হিসেব করে সেদিন পাচন রান্না করে।’
‘আবার দিনপঞ্জিকা অনুসারে অধিকাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী একদিন পর পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। এর ফলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পরিবারে পাচন রান্না হয় ১৪ এপ্রিল। ১২ তারিখ সকাল থেকেই পাচনের সবজি মূলত বিক্রি শুরু হয়েছে। আজ রাত পর্যন্ত বিক্রি হবে। হিন্দু-মুসলিম সবাই এখন পাচনের সবজি কিনছেন।’- বলেন সিয়াম
নগরীর হালিশহরের বাসিন্দা সংস্কৃতিকর্মী মোরশেদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হিসেবে আজকেই চৈত্র সংক্রান্তি পালন করছি। আমাদের বাসায় পাচন রান্না হয়েছে। পাচন খাওয়া আমাদের বাসায় একটা উৎসবের মতো। আমার মায়ের যুক্তি হচ্ছে, চৈত্র সংক্রান্তির সময় যেসব সবজি পাওয়া যায় সেগুলো শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।’
বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) সকালে নগরীর বকশিরহাট, আসকারদিঘীর পাড়, হাজারী লেইন, মোমিন রোড এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, নিয়মিত বিক্রি হয় এমন সবজি তো আছেই, সাধারণত বাজারে মেলে না এমনও প্রচুর। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে কৃষক বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি নিয়ে বিক্রির জন্য এসেছেন শহরে। পাচনের সবজি কেনার জন্য ক্রেতার ভিড়ে ঠাসা একেকটি দোকান।
বছরে শুধুমাত্র একবার পাচনের জন্য বিক্রি হয় এমন সবজির মধ্যে আছে কাট্টুস (আঞ্চলিক নাম), কাঁচা কাঠাল, তারা, ডুমুর, তিতা বেগুন, কলার খাড়া (কলাগাছের ভেতরের কাণ্ড), গিমাশাক।
এছাড়াও আছে সজনে, কাঁচা আম, কাঁচা কলা, মূলা, পটল, গাজর, লাউ, তিতা করলা, টমেটো, কাঁকরোল, বরবটি, ঢেঁড়স, কচুর ছড়া, পেঁপে, মিষ্টিকুমরা, শালবন, শসা, চালকুমড়া, আলুসহ বারোমাসী বিভিন্ন সবজি। শাকের মধ্যে আছে লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার শাক, কচুরলতি, মারিশ শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক ও ঢেঁকি শাক।
পাচনের সবজির সঙ্গে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে হারগেজি ফুল (আঞ্চলিক নাম) এবং নিম পাতাও। হারগেজি ফুল বা বিউফুলের মালা গেঁথে নিমপাতাসহ চৈত্র সংক্রান্তির দিন ঘরের দরজার উপরে টাঙানো বাঙালির পুরনো প্রথা।
আসকার দিঘীর পাড় কাঁচাবাজারে পাচনের সবজি নিয়ে আসা অনন্ত বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বলা হয়, ১০৮ রকমের পদ দিয়ে পাচন রান্না করতে হয়। এত আইটেম তো আমরা পাই না। যত বেশি পাই, সেগুলো নিয়ে এসেছি। পাচনে যত বেশি পদ ব্যবহার করা যায়, ততই সুস্বাদু হয়।’
সব বাজারেই বহু পদের সবজি কেজি হিসেবে একসঙ্গে নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে। আবার কেউ আলাদা কিনতে চাইলেও পাচ্ছেন। তবে সবজি আলাদা-আলাদা না কিনে একসঙ্গে কেনার দিকেই ঝোঁক বেশি দেখা গেছে ক্রেতাদের।
হাজারী লেইনে গৃহবধূ মিতু বিশ্বাস প্রতিকেজি ৬০ টাকা করে একসঙ্গে সাত কেজি কিনেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক কেজি মিশেল সবজি কিনলে চারজনের এক পরিবারের জন্য হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের পরিবারে সদস্য বেশি। আবার প্রতিবছর আমাদের বাসা থেকে রান্না করা পাচন প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনদের বাসায় দেয়া হয়। সেজন্য আমাকে বেশি সবজি কিনতে হয়েছে।’
নগরীর মোমিন রোডে সবজি কিনতে আসা পলাশ কান্তি নাথ রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ঢেঁড়স, পটল, আলু, বেগুন, মূলা, শিম, কলার মোচাসহ অনেক আইটেম নিয়েছি। এই পাচন খাওয়া আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটা ধর্মীয় রীতি। পাচন খাওয়ার মধ্যে শারীরিক উপকারিতা আছে। আবার রান্না করা পাচন প্রতিবেশিদের ঘরে ঘরে বিতরণ হয়। এটা সৌহার্দ্যেরও একটা চিত্র।’
এছাড়া পাচনে দেওয়া হয় মটরশুঁটি, শুকনো ফেলন ডাল, শিমের বিচিও। আবার মসুর কিংবা খেসারি ডালের বড়া বানিয়ে দেয়া হয়। ডালের দাম বেশি, সেজন্য এবার বিক্রি কম বলে জানান আসকার দিঘীর পাড় এলাকার দোকানি রূপম নাথ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডাল কিনে বড়া বানিয়ে খাওয়ার সামর্থ্য অনেকের নেই। ডালের দাম বেশি। এখন রেডিমেইড বড়া পাওয়া যায়। প্যাকেট হিসেবে নিলে সেগুলোর দাম কম আছে। স্বাদ যদিও কম, কিন্তু সেগুলোই এখন পাচনে বেশি ব্যবহার হচ্ছে।’
হাজারী লেইনের বাসিন্দা কৃষ্ণ দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘চৈত্র সংক্রান্তিতে পাচন খাওয়া আমাদের ঐতিহ্য। পুষ্টিগুণসম্পন্ন সকল শাকসবজি দিয়ে একটি তরকারি রান্না করে আমরা নতুন বছর শুরু করি। আগে শুধু হাজারী লেইনে চৈত্র সংক্রান্তির পাচনের সবজি পাওয়া যেত। অন্যান্য বাজারগুলোতে তেমন পাওয়া যেত না। এখন সব বাজারেই পাচনের সবজি পাওয়া যাচ্ছে। ১০৮ রকমের পদ দিয়ে রান্নার প্রচলন থাকলেও অনেকে কম দেন, অনেকে আবার তরকারিতে এর চেয়েও বেশি সবজি দেন। তবে স্বাদটা অসাধারণ।‘
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বাসিন্দা চলন্ত চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালন করি। তিনদিন ধরে আমাদের উৎসব হয়। চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখে আমাদের ঘরে পাচন খাওয়া হয়। পাহাড়ের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পাচন খাওয়ার সংস্কৃতি চালু আছে।’
সারাবাংলা/আরডি/ইআ