হঠাৎ হাটহাজারী মাদরাসা ঘুরে গেলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
১৩ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:০২
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসায় এসেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রায় তিন ঘণ্টা অবস্থান করে মন্ত্রী মাদরাসার মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপের পাশাপাশি একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি মাদরাসায় ইফতারে যোগ দেন।
বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) রাত পৌনে ৮টার দিকে মাদরাসা ছেড়ে যাবার সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আসার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। মরহুম শাহ আহমদ শফী হুজুর একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ওনার মৃত্যুর পর কয়েকবার মাদরাসায় আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সময়-সুযোগের অভাবে পারিনি। আজ এসে শফী হুজুরের কবর জেয়ারত করলাম।’
এর আগে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ‘হাটহাজারী বড় মাদরাসা’ হিসেবে পরিচিত আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসায় পৌঁছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এসময় হাটহাজারীর সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।
গত মঙ্গলবার হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও সিনিয়র নায়েবে আমীর মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ঈদুল ফিতরের আগেই মামুনুল হকসহ কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেন। মুক্তি না দিলে দেশের অস্থির রাজনৈতিক অঙ্গনে তৌহিদী জনতাকে শান্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে সরকারকে হুঁশিয়ার করেন তারা।
এই বিবৃতির দুইদিন পরেই হেফাজতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ‘হাটহাজারী বড় মাদরাসা’ ঘুরে গেলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
জানা গেছে, মাদরাসায় পৌঁছে আসরের নামাজ আদায়ের পর মন্ত্রী প্রয়াত মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীর কবর জেয়ারত করেন। এরপর তিনি মাদরাসা প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত মুয়াজ্জেম প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়ে ইফতারে অংশ নেন।
স্থানীয় সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘যখন দেশে জঙ্গিদের উত্থান হয়েছিল, তখন কওমি মাদরাসার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, কওমি মাদরাসা থেকে জঙ্গি সৃষ্টি হয় না, ইসলামের দ্বীন তৈরি হয়। আমরা যখন জঙ্গি দমনের অভিযান শুরু করি তখন আলেম-ওলামারা সহযোগিতা করেছেন। উনারা মসজিদে-মসজিদে গিয়ে বলেছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামে রক্তপাতের কোনো স্থান নেই। এতে আমাদের জঙ্গি দমন অভিযান সফল হয়েছে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে আলেম-ওলামারা দেশকে আলোকিত করেন। ভুলত্রুটি থাকলে সেটা ধরিয়ে দেবেন। কওমি মাদরাসার কণ্ঠরোধ হোক, সেটি আমরা চাই না। কওমি মাদরাসার যে সিলেবাস সেটি মাদরাসা বোর্ডই তৈরি করে, সেখানে আমরা কোনো হাত দিই না।’
অনুষ্ঠান ও ইফতার শেষে মন্ত্রী মাদরাসার বর্তমান মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইয়াহইয়াসহ জ্যেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন, যাদের অনেকেই হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও যুক্ত।
হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রুহুল আমীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার নিজেই মাদরাসায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মন্ত্রী মহোদয়ের জন্য ইফতারের আয়োজন করে। উনাকে সম্মান জানিয়ে ক্রেস্টও দিয়েছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কর্মসূচিতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর মাদরাসায় যাবার কথা থাকলেও পরে সেটি বাতিল করা হয়।
কওমি মাদরাসাটির মহাপরিচালক শাহ সালহ উদ্দীন নানুপুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন বলে আমাদের জানানো হয়েছিল। দুপুরে আবার সেটি বাতিল করা হয়েছে। তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় এসে সেখান থেকে চলে গেছেন।’
প্রায় ৩৪ বছর ধরে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসায় মহাপরিচালক পদে ছিলেন শাহ আহমদ শফী। শেষদিকে এসে মাদরাসার কর্তৃত্ব নিয়ে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্বের জেরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনদিন আহমদ শফীর বিরুদ্ধে হাটহাজারী মাদরাসায় ছাত্র বিক্ষোভ হয়। মাদরাসার অভ্যন্তরে ভাংচুর হয়। বেশ কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়, যারা ছিলেন শফীর অনুসারী। এমনকি শফীর কক্ষও ভাংচুর করা হয়। বিক্ষোভের মধ্যে একপর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভের মধ্যেই ১৮ সেপ্টেম্বর প্রায় শতবর্ষী শাহ আহমদ শফী মারা যান।
এরপর শফীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত মাদরাসার সহকারী পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরীর কর্তৃত্বে চলছিল এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। ২০২০ সালের ১৯ আগস্ট তিনিও মারা যান।
২০১০ সালে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন শফী ও বাবুনগরী। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের দাবি তুলে ২০১৩ সালের ৫ মে সারাদেশ থেকে লংমার্চ নিয়ে ঢাকার শাপলা চত্বরে গিয়ে অবস্থান নেওয়া এবং ব্যাপক সহিংতার পর সংগঠনটির ব্যাপক পরিচিতি মেলে। একইভাবে হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসাও প্রশাসনসহ সর্বস্তরের আগ্রহ ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।
সারাবাংলা/আরডি/একে