Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈশাখের জয়গানে আর শোভাযাত্রায় মঙ্গলের আবাহন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:৪২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চির নূতনের ডাক দিয়ে বাঙালির জীবনে আরেকবার আসা পহেলা বৈশাখকে বরণে উৎসবের রঙ লেগেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। দিকে দিকে বৈশাখের জয়গান। বৈশাখ আবারও দিয়েছে চির সম্মিলনের বার্তা। ছন্দ-আনন্দের দোলায় নতুন বছরে শুরুতে পরস্পর মিলেছে শুভেচ্ছার আলিঙ্গনে।

মঙ্গলের আবাহনে বের হওয়া বর্ণিল শোভাযাত্রায়ও ঘটেছে আপামর মানুষের সম্মিলন। ধর্মান্ধতা, হিংসা-বিদ্বেষ, গ্লানি ঝেড়ে আবহমান বাংলার সর্বজনীন সংস্কৃতিকে রক্ষার তাগিদ এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রায়।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবছরের মতো এবারও চট্টগ্রামে বর্ষবরণের বড় দু’টি আসর বসেছিল সিআরবির শিরীষতলা ও ডিসি হিলে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমিতে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও সবুজ চত্বরেও ছিল প্রাণের মেলা। অন্যদিকে, নগরীর চবি’র চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা, চারুশিল্পী সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করেছে। তবে রমজানের কারণে প্রতিটি আয়োজনই এবার সংক্ষিপ্ত পরিসরে করা হয়েছে।

পুলিশের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল প্রতিটি আয়োজন। কাঠফাটা রোদ আর তীব্র গরমের মধ্যেও জনসমাগমের কমতি ছিল না বর্ষবরণের আসরগুলোতে। নতুন শাড়ি, নতুন পাঞ্জাবি জড়িয়ে অলি-গলিতে সরব পদচারণা উৎবসপ্রিয় বাঙালির। শিশু কিশোর, তরুণ তরুণী, বৃদ্ধরাও নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

তবে আয়োজকরা মনে করেন, পুলিশের পক্ষ থেকে সময় বেঁধে দেওয়া, রমজানের কারণে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করাসহ নানা সীমাবদ্ধতা না থাকলে জনসমাগম আরও বেশি হতো।

শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৭টায় সিআরবির শিরীষতলায় সাংস্কৃতিক সংগঠন শীলা দাশগুপ্তার সঞ্চালনায় ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের পঞ্চদশ আয়োজন। নববর্ষ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের উদ্যোগে এই আয়োজনে রবীন দে সঙ্গীত বিদ্যালয়, সঙ্গীত ভবন, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, সুর সাধনা সঙ্গীতালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে সাংস্কৃতিক ফোরাম, উদীচী চট্টগ্রাম, স্বরলিপি সাংস্কৃতিক ফোরাম, সৃজামী, অদিতি সঙ্গীত নিকেতনসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সম্মিলিত গান পরিবেশন করেন। বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, শব্দনোঙ্গর, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসসহ কয়েকটি সংগঠনের শিল্পীরা বৃন্দআবৃত্তি পরিবেশন করেন। ওড়িষি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যনীড়, রাগেশ্রীসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন।

বিজ্ঞাপন

নববর্ষ উদযাপন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. মনিরুজ্জামানকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে বর্ষবরণের মঞ্চে। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিকেল চারটায় অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

সিএমপির পক্ষ থেকে সিআরবির শিরীষতলার অন্তত এক কিলোমিটার দূরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্রের সামনে প্রতিবন্ধক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিআরবিতে প্রবেশের তিন দিকেও গাড়ি প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে শিরীষতলায় যেতে লোকজনকে গরমের মধ্যে হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকদূর। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ভোগান্তিও ছিল। বিশেষ করে যেসব শিল্পীরা মঞ্চে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, তাদেরও পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে।

নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রামের সহ সভাপতি ডা. চন্দন দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোভিড সংক্রমণের কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর আমরা গতবছর থেকে ফের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শুরু করেছি। কোভিডের ধাক্কা এবং রমজানের কারণে গতবছর সমাগম কিছুটা কম ছিল। এবার সমাগম বেড়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নানা হুমকির মধ্যেও মানুষ সমবেত হয়েছে তাদের প্রাণের উৎসবে। বাঙালি কখনোই রক্ষণশীলতা-পশ্চাৎপদতার কাছে পরাভব মানেনি। এবারও বর্ষবরণের আয়োজনে চট্টগ্রামে মানুষ প্রমাণ করেছে যে, বাঙালি তার জাতিসত্তার আবহমান ঐতিহ্যের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল।’

রমজানের জন্য আয়োজন সংক্ষিপ্ত হওয়ায় এবার সাহাবুদ্দীনের বলিখেলা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

এদিকে নগরীর ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে শুক্রবার সকাল ৭টায় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের আয়োজন। ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ, গুরুকুল সংগীত একাডেমি, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমি, গুরুকুল, ঘুঙুর নৃত্যকলা কেন্দ্র, সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমি, নৃত্য নিকেতন, দি স্কুল অব ফোক ডান্স, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, স্বরনন্দন প্রমিত বাংলা চর্চা কেন্দ্রসহ ৩২টি সংগঠনের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন। বেলা ১২টায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন আয়োজকরা।

ডিসি হিলে প্রবেশর আশপাশের সড়কগুলোতেও যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় সিএমপি। নগরীর ডিসি হিল, চেরাগি পাহাড়, বোস ব্রাদার্সের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে মুক্তমঞ্চের দিকে। পুলিশের কড়াকাড়িতে গরমের মধ্যে ভোগান্তিতে পড়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে।

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকেও বর্ষবরণ উপলক্ষে সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। শিল্পকলার অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিশু একাডেমি, ফুলকিসহ নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সংস্কারকাজের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এবার নগরীতে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বাতিল করে। তবে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে নিজ উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। সেই শোভাযাত্রার ব্যানার এবং শিক্ষার্থীদের বানানো প্রতিকৃতিগুলো ছিল সাদা-কালো।

ঢোলবাদ্যের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা নগরীর বাদশা মিয়া সড়ক থেকে চট্টেশ্বরী রোড হয়ে কাজির দেউড়ি ঘুরে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে এসে শেষ হয়। একইস্থান থেকে চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘চট্টগ্রাম চারুশিল্পী সম্মিলন’ মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। উদীচীর পক্ষ থেকে নগরীর আন্দরকিল্লা থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা ডিসি হিলে গিয়ে শেষ হয়।

চারুকলা ইনস্টিটিউটের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শিহাব শাহরিয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমরা মূল ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনে আছি। আমাদের আন্দোলন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ এবার বর্ষবরণের কোনো আয়োজন করেনি। আমরা নিজ খরচে নিজস্ব উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা করেছি। সাদা-কালো আয়োজনে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি।’

শিরীষতলায় বর্ষবরণের আয়োজনে শামিল হওয়া শ্রমিক নেতা নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সর্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে উসকানি দিচ্ছে, এবারের পহেলা বৈশাখে মানুষের সমাগম তাদের গালে চপেটাঘাত করেছে। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ও এই উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রার যেমন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গাওয়ার ইতিহাস আছে, তেমনি অন্যায়-অত্যাচার, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা অবসানের লক্ষ্যে মানুষকে জেগে ওঠারও আহ্বান জানায়।’

নগরীর ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখের উৎসবে যোগ দেওয়া কলেজ শিক্ষিকা তানিয়া আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ সর্বজনীন সম্মিলনের কথা বলে, মানবিকতার কথা বলে। বাঙালির এই সম্মিলিত উৎসব থেকে আমরা সবধরনের অনাচার, অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানাই এবং মানবিক সমাজ নির্মাণের কথা বলতে চাই।‘

সাংস্কৃতিক সংগঠক শিমুল সেনগুপ্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে সবাই মানুষ। তারপর আমরা একেকজন একেক ধর্মের অনুসারী। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, পৌষপার্বণ, নবান্ন এগুলো আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতি। আপামর মানুষের এই সংস্কৃতি যেদিন সারা বাংলাদেশে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারব, সেদিনই আমরা সুন্দর স্বদেশ পাব।’

নগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার অতনু চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্ষবরণের বড় দুটি আয়োজনই হয়েছে কোতোয়ালি থানা এলাকায়। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দু’টি আয়োজনই সুন্দরভাবে হয়েছে। আমাদের থানার টিমের পাশাপাশি সোয়াট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, কুইক রেসপন্স টিম, ডিবি মাঠে ছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরও পুলিশ সদস্যদের মাঠে রাখা হয়েছে। কারণ, ছুটির দিন হওয়ায় অনেকেই বিভিন্নস্থানে বেড়াতে যাচ্ছেন। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে আমরা তৎপর আছি।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

আবাহন টপ নিউজ নববর্ষ বৈশাখ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

চট্টগ্রামে খালে ভাসছিল অর্ধগলিত লাশ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৩

বিএসইসি‘র চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫১

সম্পর্কিত খবর