Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মজিদ মাহমুদ: কাব্যাঙ্গনে স্বতন্ত্র অভিযাত্রী

ফরিদ আহমদ দুলাল
১৬ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৩৭

“তোমার দালান রক্তে ও ঘামে ঘামে
তোমার দালান অন্যের পরিশ্রমে
তোমাকে কাটবে অন্ধকারের কীট
রক্ত ও পুঁজ শেয়াল শকুন চাটবে মধ্যযামে।”

কবি মজিদ মাহমুদ-এর লেখা উপরের পংক্তি পড়ে তাকে ঠিক যে চরিত্রের কবি মনে হবে, তিনি ঠিক সে মেজাজের কবি নন। ক্লাসিক-রোমান্টিক এবং নিও-রোমান্টিক ধারার মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে কবিতা লিখলেও তাকে এ সময়ের সচেতন কবি বলেই চিহ্নিত করা যায়। তার কবিতার বিষয়-আঙ্গিক, তার কবিতার শৈলী নির্মাণ এবং তার কবিতায় প্রকরণ সচেতনতায় পাঠক অন্তরে তেমন প্রতীতি-ই জন্মায়। মজিদ মাহমুদ প্রচুর লিখেছেন, এবং তার লেখা বৈচিত্র্যগুণেও অনিন্দ্য। মজিদ মাহমুদ যতটা না কবি তারচেয়েও বেশি সমাজতাত্ত্বিক, মজিদ মাহমুদ গবেষক-প্রাবন্ধিক এবং তিনি অসাধারণ গদ্যশৈলীর নিপুণ কারিগর; আর সর্বপোরি তিনি যে একজন যোগ্য বাগ্মি সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন বারবার। মজিদ মাহমুদ সম্পর্কে আমার এ নাতিদীর্ঘ বাক্য পড়ে যারা ভাবছেন, আমি কবি মজিদ মাহমুদকে কিছুটা খাটো করে উপস্থাপন করতে চাইছি, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের সেই মাধ্যম, যেখানে কেউ সাফল্য পেলে সাহিত্যের অন্য যে কোন শাখায় সফলতা পাওয়া সম্ভব। মজিদ মাহমুদ ‘মাহফুজামঙ্গল’ (১৯৮৯) কাব্য লিখে শুধু যে বাংলা কবিতার এক অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন, তাই নয়, ঐতিহ্যের নবায়নেও অবদান রেখেছেন। মজিদ মাহমুদ তার স্বল্পপরিসর জীবনে যে বৈচিত্র্য তার পাঠককে দিতে পেরেছেন, তার সমসাময়িকদের মধ্যে অন্যরা তা কমই পেরেছেন; হাতে গোনা দু’একজনের নাম হয়তো আমরা উচ্চারণ করতে পারবো চেষ্টা করলেই, কিন্তু তারপরও মজিদ মাহমুদ তার সামর্থের বিচারে ইতোমধ্যেই অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নিজেকে। যারা তার অন্তর্লোক পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করবেন, কেবল তারাই জানবেন তার অবস্থান ঠিক কোন উচ্চতায়। যারা তার চিন্তার ঔদার্যের নাগাল পাবেন তারাই মানবেন, আমি মোটেই মিথ্যা স্তুতি করিনি তার নামে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আমি বরং এখানে ক’জন গুণী মানুষের বক্তব্য উপস্থাপন করছি। ভাষাসৈনিক ও রবীন্দ্রগবেষক ড. আহমদ রফিক বলেছেন, “মজিদ মাহমুদের কবিতার মধ্যে ক্ষোভ, বেদনা, দ্রোহ শৈল্পিকভাবে প্রতীকায়িত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতো এই কবি বৈচিত্র্যের পিয়াসী। আমার বিশ্বাস মাহফুজামঙ্গলের পরে এই কবির হাতে একটি নিখুঁত সমাজমঙ্গল-কাব্য রচিত হবে।” কবি ও কাব্যকোবিদ মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, “মজিদ মাহমুদ সচেতনভাবে কাব্যচর্চা করেছেন। এই সচেতনতার মধ্য দিয়ে তিনি নিজস্ব একটি কণ্ঠস্বর ও প্রকাশভঙ্গি নির্মাণ করতে পেরেছেন।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বেগম আকতার কামাল বলেছেন, “আমি বিস্ময়করভাবে লক্ষ করেছি, আধুনিক কবিদের আবিষ্ট করে রাখেন যে কবি জীবনানন্দ দাশ, তাকে আমি তার কবিতায় খুব একটা পাচ্ছি না; এই যে এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি, এড়িয়ে গেলেন জীবনানন্দ দাশকে- এটা তার ক্ষমতার পরিচায়ক।” অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “মজিদ মাহমুদ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থেই নিজের কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।…. তার কবিতা পড়তে গেলে মেরুদ- সোজা রাখতে হয়।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক ড. রফিকউল্লাহ খান তার কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, “মজিদ মাহমুদ যে এখনো ভালো কবিতা লিখছেন এবং ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন, এটি আমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।”
এত এত প্রাজ্ঞের প্রশংসাাবাক্য উচ্চারণের পর তার সম্পর্কে কী-বা আর বলার থাকতে পারে! কিন্তু আমি পথের পাশের তৃণটি হই, আমার সবুজটি তো আলাদা। তাই নিশ্চিত করে বলতে পারি, লিখতে যখন বসেছি, নিজের পাঠ প্রতিক্রিয়ার কথাটি আলাদা করে উচ্চারণ না করলে, দায় থেকে মুক্তি পেতে পারি না। আমার পাঠক হয়তো আমায় ছাড় দিতে পারেন, আমি নিজে কিছুতেই ছাড় দিতে পারি না। সুতরাং অন্যের জিভে স্বাদাস্বাদনের চেয়ে নিজের মেধা-মনন-মনীষা আর বিবেচনাকে গুরুত্ব দিয়ে মজিদ মাহমুদকে আমার পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে চাই।

বিজ্ঞাপন

একজন কবি কখনোই দশকের গণ্ডিতে বন্দী থাকতে পারেন না; বহুবার উচ্চারিত এ সত্যটিকে মনে রেখেও; আলোচনার সুবিধার্থে কবির বিকাশকালের কথা মনে রেখে বলবো, মজিদ মাহমুদ গতশতকের আটের দশকে বাংলা কবিতায় নিজের প্রতিভার উচ্চারণে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে কাব্যাঙ্গনে। আমরা যদি তার প্রকাশনার তালিকায় তাকাই, সহজেই বুঝে নিতে পারি কবির বিকাশ প্রক্রিয়াটি। বিশেষ আগ্রহের বিষয়টি এই, তার প্রথম কাব্য পাঠককে কোন শক্তিতে এতোটা আলোড়িত করলো? একজন তরুণ কবির কবিতায় পাঠক সেদিন কী আবিষ্কার করেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরেই পাওয়া যাবে মজিদ মাহমুদের কবিতার শক্তি। মজিদ মাহমুদ-এর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশনা অভিযাত্রা শুরু ‘মাহফুজা মঙ্গল’ (১৯৮৯) দিয়ে, ১৯৮৯-তে যে ‘মাহফুজা মঙ্গল’-এর যাত্রা শুরু ২০১৪ পর্যন্ত সেই মাহফুজা মঙ্গল কাব্যের পঞ্চম প্রকাশ সম্পন্ন হয়েছে। এরপর ‘গোষ্ঠের দিকে’ (১৯৯৬), ‘বল উপাখ্যান’ (২০০০), ‘আপেল কাহিনি’ (২০০২), ‘কাঁটা চামচ নির্বাচিত কবিতা’ (২০০৫), ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’ (২০০৬), ‘অনুবিশ্বের কবিতা’ (২০০৮), ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ (২০১২), ‘কবীরের শত দোঁহা’ (২০১২), ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’ (২০০২), ‘গ্রামকূট’ (২০১৫), ‘ভালোবাসা পরভাষা’ (২০১৫), ‘কাটাপড়া মানুষ’ (২০১৭), ‘লঙ্কাবি যাত্রা’ (২০১৯), ‘শুঁড়িখানার গান’ (২০১৯), ‘শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা’ (২০২২), ‘যুগল পদ’ (২০২৩) ইত্যাদি নামের ১৭টি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে তার। প্রকাশিত হয়েছে ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০০৫), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০০৮) এবং ‘কবিতামালা’ (২০১৫)।

কবিতার পাশাপাশি তার অন্যান্য প্রকাশনার মধ্যে আছে কিশোর কবিতা ‘বৌটুবানী ফুলের দেশে’ (১৯৮৫), ছোটগল্প সংকলন ‘মাকড়সা ও রজনীগন্ধা’ (১৯৮৬), প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থ ‘নজরুল, তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র’ (১৯৯৬), ‘কেন কবি কেন কবি নয়’ (২০০৩), ‘নজরুল মানুষ ধর্ম’ (২০০৪), ‘ভাষার আধিপত্য ও বিবিধ প্রবন্ধ’ (২০০৫), ‘উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্য ও অন্যান্য’ (২০০৭), ‘রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণসাহিত্য’ (২০১০), ‘সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা’ (২০১০), ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভারতবর্ষ’ (২০১২) এবং ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (২০১৪) ইত্যাদি। মজিদ মাহমুদ সম্পাদনা করেছেন, ‘আশির দশক কবি ও কবিতা’ (১৯৯১), ‘বৃক্ষ ভালোবাসার কবিতা’ (২০০০), ‘জামরুল হাসান বেগ স্মারকগ্রন্থ’ (২০০৩) ও ‘মধুসূদন দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০১১)। মজিদ মাহমুদের প্রকাশনা তালিকা পড়েও আমরা সহজেই তার সাহিত্যকৃতির একটা ধরণা পেতে পারি। মজিদ মাহমুদের কবিতার আলোচনায় প্রবেশের আগে তার একটা কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছি—

বিজ্ঞাপন

আমি তো লিখতেই চেয়েছিলাম
আমি তো লিখেই বুড়ো হয়ে গেলাম
লিখতে লিখতেই তোমায় কুড়িয়ে পেলাম
লিখতে লিখতেই তোমায় হারিয়ে ফেললাম
লিখতে লিখতেই পিতার হাত ফসকে
মায়ের আঁচল ধরলাম
আবিষ্কার করলাম মায়ের অন্ত্রের অসুখ
পানির সাথে খেলতে থাকলাম
লিখলাম তার মুখ
লিখতে লিখতে জানলাম তার বুকের অসুখ
পিস্টিল থেকে জুড়ে দিলাম কান্না
মা আমায় ছেড়ে কোথাও তো যাবে না
আমি নেব তোমার বক্ষের কর্কট রোগ
আমি নেব তোমার জীবনের ভোগ
আমিও যে মা তোমার মত ধরি
তোমার পথে তোমার নামে লড়ি
লড়তে লড়তে লিখি
লিখতে লিখতে লড়ি
লেখার সাথে জেগে উঠি লেখার সাথে মরি
একটি মেয়ে বলল আমায় লেখ
বলল লিখলি বটে এবার পড়ে দেখ
পড়তে গিয়ে দেখি
ওমা এ সব আমি লিখি
নদী লিখি পাখি লিখি টিলা লিখেছিলাম
মেঘের সাথে উড়ে এসে বৃষ্টি ঢেলে দিলাম
পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে ফেলি
বলি মেয়ে লেখা তো নয় চল একটুখানি খেলি
খেলতে গিয়ে পাড়ার ছেলে মেয়ে
কেউবা এসে বাবা বলে কেউবা দুলা ভাই
এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে লেখার কলমটাই
এখন তোমার নাম দিয়েছি লেখা
এখন আমার পাঠের সময় গ্রন্থ খুলে দেখা
এক লিখেছি দুই লিখেছি অনন্ত অম্বর
তোমায় ছাড়া সকল বর্ণ- আঁধার ঘনঘোর।
(লেখা ॥ মজিদ মাহমুদ)

মজিদ মাহমুদের কবিতা পড়তে পড়তে কখনো মনে হয় তার কবিতা যেন সুসংঘবদ্ধ নয়, মনে হবে যেন অতিকথন দোষে দুষ্ট। কবিতাটির ক’টি চরণ উদ্ধৃত করতে চেয়েও পূর্ণ কবিতাটি উপস্থাপনের লোভ ত্যাগ করতে পারলাম না; কেন? আমি তার কবিতায় বাহুল্যবর্ণনের প্রবণতাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু পুনর্পাঠে দেখলাম কবিতাটিতে বাদ দেবার মত পংক্তি নেই; কবিতার ভঙ্গিটি এলায়িত বটে; কিন্তু কোথায় যেন একটা পূর্ণতা বিরাজমান। পুনর্পাঠে মনে হলো, কবিতাটি যেন অতিকথন দাবী করে, যেন এলায়িত ভঙ্গিটিও প্রত্যাশা করে। পাঠক আপনি নিজেও পুনর্পাঠ করে দেখতে পারেন, আমার কথা যৌক্তিক কি-না! মজিদ মাহমুদের কবিতায় এই এলায়িত আবশ্যিকতাকে আমি গুরুত্বের সাথে দেখতে চাই। মনে হয় এ-ও মজিদ মাহমুদের কাব্যস্বাতন্ত্র্য। ‘লেখা’ কবিতাটিতে মজিদ মাহমুদ এমন সব বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটালেন, যা আমার হৃদয়তন্ত্রীকে স্পর্শ করে; কেন না একই কবিতায় মাতৃভক্তি, জন্মঋণ, দেশপ্রেম-মৃত্তিকাসংলগ্নতা, প্রেয়সীর প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা এবং নিজের সৃষ্টিশীলতাকে সম্পৃক্ত করেছেন সযত্নে এবং তা সচেতনার সাথেই; একই কবিতায় নিজের সমাজমনষ্কতার স্বাক্ষরও রেখেছেন কুশলী নির্মাণশিল্পীর মুন্সিয়ানায়।

নিজের দেশ এবং মাতৃভূমি প্রসঙ্গে তার আবেগের উচ্চারণ আমরা আরও দেখি তার কবিতায়। আমরা নিচের কবিতাটির প্রতি মনোযোগী হতে পারি—

আমি বলছি, বাংলাদেশ জিতেছে
তুমিও তাই বলছ, আমিও তাই বলছি
তুমি হারলে, আমি হারলে- বাংলাদেশ হারে
বাংলাদেশ জিতলে তুমি জেতো, আমি জিতি
তুমি যখন একাই জিততে চাও
তখন তুমিও হার, আমিও হারি
বাংলাদেশ হারে না- হারতে হারতে জিতে যায়
একটা উইকেট পড়ে গেলে আরেকটা থাকে
সবগুলো পড়ে গেলেও
ঘুরে দাঁড়াবার আকাক্সক্ষা থাকে
তিরিশ লক্ষ পড়লেও
আরো তিরিশ কোটি পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে
আমরা হারতে হারতে জিতে যাই
জিততে জিততেও জিতে যাই
বাংলাদেশ সবসময় জেতে- বাঙালিকে দেখ
এক বাঙালিই তো শুরু করেছিল
এক বাঙালির সাথে
আজ কোটি কোটি বাঙালি
কোটি কোটি বাঙালির সাথে
যারা মারতে এসেছিল তারা মারা গেছে
যারা বন্ধু ছিল তারা জেগে আছে
বাংলাকে মারতে এলে আমরা মেরে দিই
বাংলা আমার মায়ের মা, পিতার পিতা
তাদের প্রতিটি চিহ্ন রেখেছে ধরে এই বাংলা
বৈদিক বলেছিল সংস্কৃত হও
ব্রিটিশ বলেছিল ইংরেজ হও
পাকিরা বলেছিল উর্দু হও
আমরা বাঙালি ছিলাম বাঙালি হয়েছি
বাংলাকে দাবিয়ে রাখবে কে
বাংলাদেশ থাকে বাঙালির মুখে
বাংলাকে হারাবে কে
বাঙালি গেলে বাংলাদেশ সাথে যায়
বাঙালি ফিরলে বাংলাদেশ ফেরে
বাংলার জন্যই তো দেশ
বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ
যারা বাংলায় কথা বলে তারাই দেশ
যারা বাংলা জানে না তারাই বিদেশ
দেশের মধ্যেও বিদেশ থাকে
বিদেশেও থাকে দেশ
সবখানে বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!!
(বাংলাদেশ ॥ মজিদ মাহমুদ)

উল্টেপাল্টে চিনে নেয়ার চেষ্টা; যখন বাহুল্যের কলঙ্ক নেমে আসতে চায় তখন যেনো আবেগ এসে কলঙ্ক মোচনে প্রবৃত্ত হয় এবং কবিকে বৈতরণী পার করে দিতে চায়। তবুও সংযমী না হবার দ- যেনো খড়গ হয়ে নামতেই চায় কবির উপর। ঠিক তখন কবির আরও একটি বিলম্বিত লয়ের কবিতা এসে দাঁড়ায় তার পাশে এবং আমাদের চিনিয়ে দিতে চায় একজন সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিকের মুখ, আমাদের সামনে একজন কবিকে দাঁড় করিয়ে দেয় এই বলে, এ কবি অতীত মনে রাখেন, নিষ্ঠ পাঠে জেনে নেন অতীতের লড়াই-সংগ্রাম, এ কবি ইতিহাস ধারন করেন কবিতায়, সমকাল এবং আন্তর্জাতিকতা ধারন করেন, ধারনে করেন রাজনীতি; তার কবিতার পেলব-কোমল পংক্তিতে। এতকিছু ধারন করেন বলেই তিনি উচ্চারণ করতে পারেন—

আমার ঘরের দরোজা আজ খুলেছি রাতে
কুকুরের তাড়া খেয়ে যে সব মানুষ রয়েছে তফাতে
যে সব শিশুরা ডুবিছে পানিতে
তাদের তরুণ দেহখানি তুলে নিতে
আমিও যে মানুষ ছিলাম অন্তত গল্পে শুনেছি
তার পরিচয় কখনো কি দিয়েছি
কখনো কি নিজের ব্যঞ্জন থেকে
একটি শাকের ডাটা দিয়েছি তাদের দিকে
কখনো কি বলেছি- এসো ভাই
যে সব জানোয়ার তোমাদের তাড়ায়
আমরা তাদের সাথে নাই
এসো ভাই- এই নাও তৃষ্ণার জল
আমাদেরও নাই খুব বেশি সহায় সম্বল
যদিও আমাদের বাড়ির আঙিনা
আমাদের থাকার জন্য যথেষ্ট না
তবু মানুষ ডুববে পানিতে
মানুষ মরবে উত্তরের শীতে
বুলেটের তাড়া খেয়ে যারা এসেছে পালিয়ে
যাদের ঘরবাড়ি শিশুদের দিয়েছে জ্বালিয়ে
তাদের কি এখনো বলব তফাত
তাদের কি বলব তোমরাও বজ্জাত
এখানে হবে না তোমাদের ঠিকানা
এখানে কুকুর ও মানুষের প্রবেশ মানা
আমার অন্তর আজ এইসব জিঘাংসার অপরাধে
নীরবে নিভৃতে একাকী কাঁদে
তাই আজ রাতে খুলেছি আমার ঘরের কপাট
দিয়েছি লিখে এই নিঃস্বদের রাজ্যপাট
অনেক হয়েছে ভাই- এবার ধরো প্রতিরোধের লাঠি
আকড়ে ধর মা মাটি
মারো- মরো নিজের মৃত্তিকায়
আমরা সাথে আছি- তোমাদের ভাই
দানব বধের মন্ত্র আমাদের আছে জানা
মানুষ বিপন্ন হলে আমরা নিশ্চুপ থাকি না।
(মানুষ ॥ মজিদ মাহমুদ)

মানবিক মূল্যবোধের নিবিড় বুননে মজিদ মাহমুদ-এর এই যে প্রতিবাদ, এই যে মানবিকতার সাথে সংহতি প্রকাশ; এই যে তার বিদ্রোহ, সে বিদ্রোহের সাথে কবি নরজরুলের বিদ্রোহের সাযুজ্য নেই; তার বর্ণনা ভঙ্গির সাথে রবীদ্রোত্তর আধুনিক কবিদের বর্ণনা ভঙ্গির সামান্য মিলও নেই। তবে কি তার কবিতায় ঐতিহ্যের সন্ধান করতে আমরা মুকন্দ দাশের বিদ্রোহের সাথে সাযুজ্য খুঁজবো? আমরা কি তার কবিতায় লোকবাংলার সুর সন্ধান করবো? এসব ভাবনা যেন বারবার আচ্ছন্ন করতে চায়; কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা-মননে, তার কবিতার শৈলীকুশলতায়-মনীষার উচ্চারণে কোথাও তো আধুনিকতা প্রকাশে ন্যুনতম ঊনতা দেখতে পাই না। মজিদ মাহমুদ যেনো নিজের ঘোরে তার কবিতার নিজস্ব ভুবন তৈরি করতে সচেষ্ট থাকেন সর্বদা। মজিদ মাহমুদকে তার মতো করে দেখতে চাই বলে, তার অজস্র কবিতা থেকে সামান্য ক’টি কবিতা আদ্যপান্ত উচ্চারণ করতে চেয়েছি। স্বল্প উচ্চারণের মাধ্যমে বিস্তৃত আস্বাদনের আমন্ত্রণ জানাতে চাইছি পাঠককে। আমার বিশ্বাস মজিদ মাহমুদের কবিতা বহুল পাঠে আমরা আমাদের সমাজপ্রগতির চিন্তাকেও কিছুটা এগিয়ে নিতে পারবো। ড. বেগম আকতার কামাল তার বক্তব্যে মজিদ মাহমুদের কবিতায় জীবনানন্দের অনুপস্থিতিতে যে আশাবাদের ইঙ্গিত দিয়েছেন তা যে নিরর্থক নয়, তা-ও সহজেই সত্য বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। অবশ্য কখনো কিছুটা সংশয়ও জাগে, আমাদের সমস্ত বিশ্বাসের মূল্য দিতে গিয়ে মজিদ মাহমুদ কি তার কবিতাকে দর্শনভারাক্রান্ত করে ফেলতে পারেন? সেইসব সংশয় ও বিশ্বাসের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই কবির আরও একটি কবিতা উচ্চারণের মাধ্যমে বর্তমান আলোচনার ইতি টানতে চাই।

বন্ধু শব্দটি পৃথিবীতে স্বর্গের মতো ধারণাপ্রসূত
হয়তো নেই, তবু চেতনায় উপস্থিতি প্রবল
মৃত্যুর পরে কাক্সিক্ষত উদ্যান নেই- বলা কঠিন
কাক্সিক্ষত বন্ধুত্ব নেই- বলা সহজ
বন্ধু এমন এক আশ্রয়ের নাম
দুটি জীবিত সত্তায় তার বসবাস অলীক
বন্ধুত্ব কেবল সুখ ও সমর্থন চায়
নিজের অপূর্ণ ও দূর্বলতায় নির্ভয়
বন্ধুত্ব আসলে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে
মানুষের অমরতার আকাক্সক্ষা থেকে এর জন্ম
বন্ধুর লিঙ্গ আছে, আবার নেই
বন্ধুত্ব অনেকটা স্বমেহনের মতো
ঠিক তুমি যেমনটি চাও তেমন হতে হবে তাকে
তুমি যখন বেদনায় মুষড়ে পড়
তখন চাও কেউ তুলে নিক তোমার হাত
কামনায় জর্জরিত হলে উপশমের উপায়
একজন বন্ধু থাকলে মানুষ সব করতে পারে
একজন বন্ধুর প্রত্যাশায় মানুষ সব করে
বিপ্লব ও জেহাদ- এ তো বন্ধুত্বের অন্বেষণ
মানুষ পৃথিবীতে বন্ধু পায় না বলে
মৃতদের জগতে করে তার খোঁজ
মানুষ মরে যাবে বলে চায় একজন খাঁটি বন্ধু
যখন সে মৃত্যুতে ঢলে পড়বে- ফাঁসি বা গিলোটিনে
কেউ একজন তুলে নেবে তার হাত
গচ্ছিত রাখবে পৃথিবীর স্মৃতি ও সম্পদ
তবে পৃথিবীতে যেমন স্বর্গ আছে
তেমন অমর বন্ধুও আছে
সে একা কিন্তু সর্বত্র বিরাজিত
তাই মাঝে মাঝে তুমি কিছু বন্ধুর দেখা পাও
এবং হন্যে হয়ে তার পিছে লেগে থাক
কিন্তু অস্থির চঞ্চল বন্ধু চলে যায় অন্য শরীরে
তুমি আবার করো তার খোঁজ
না পাওয়ার বেদনায় কাঁদ
তবু অপসৃত বন্ধুকে করো না অসম্মান
যেখানে পাও তার আভাস, আকড়ে ধর
কারণ বন্ধু পৃথিবীতে স্বর্গের ধারণার নাম!
(বন্ধু ॥ মজিদ মাহমুদ)

সারাবাংলা/পিটিএম

কবি ফরিদ আহমেদ দুলাল মজিদ মাহমুদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর