Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দুর্ঘটনার পর স্টেশন মাস্টার পালাল কেন— প্রশ্ন স্থানীয়দের

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৬ এপ্রিল ২০২৩ ২২:৩৮

ঢাকা: কুমিল্লার নাঙ্গলকোর্ট উপজেলার হাসানপুর স্টেশনে দুর্ঘটনায় পড়েছে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন। স্টেশনটিতে আগে থেকেই থেমে থাকা একটি কনটেইনারবাহী ট্রেনকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন ও ছয়টি কোচ লাইনচ্যুত হয়। এতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি হতাহতের শিকার হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা উদ্ধার কাজে এগিয়ে এলেও সেখানে ছিল না স্টেশন মাস্টারসহ কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা জানান, সোনার বাংলা একটি বিরতিহীন ট্রেন। এটি হাসানপুর স্টেশনে দাঁড়ানোর বা ধীরে যাওয়ারও কথা না। কিন্তু ট্রেনটি যে লাইনে প্রবেশ করে সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল ৬০১ আপ বিএফসিটি কনটেইনার ট্রেন। সম্ভবত কোনো নির্দেশনা না পেয়ে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি সেই লুপ লাইনে প্রবেশ করে। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক সামনে আরেকটি কনটেইনার ট্রেন দেখতে পেয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করে নিজের গাড়ি স্লো করে নেওয়ার। কিন্তু চাইলেই তো আর একটি দ্রুতগতির ট্রেনকে থামানো যায় না।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা আরও জানান, সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের চালক শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। পরে এক পর্যায়ে তিনি নিজেও চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দেন। এর পরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ইঞ্জিনসহ সাতটা বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। আমরা এখানে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করলেও সেই সময় স্টেশনের কাউকে দেখিনি। পরবর্তী সময়ে স্টেশনের কক্ষে গিয়ে মাস্টারকে খোঁজার পরে তাকে পাওয়া যায়নি। সেখানে স্টেশনের অন্য কেউই ছিল না।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ট্রেন থেকে আহতদের বের করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় স্থানীয় চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি) মিলে সবাইকে উদ্ধার করার কাজ শুরু করে। একটু পরে লাকসাম থেকে ফায়ার সার্ভিসের দল এসে পৌঁছালেও রাত ৯টা পর্যন্ত লাইন ঠিক করার জন্য কোনো রিলিফ ট্রেন আসেনি।

তারা বলেন, অনেক বড় একটা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ছিল আজ। কিছু মানুষের গাফিলতিতে এমন দুর্ঘটনা খুবই ভয়ংকর। আমরা স্টেশনের কাউকেই খুঁজে পাইনি। এমনটা কিভাবে সম্ভব? লাইন দিতেও ভুল করেছে। এর পর আবার পালিয়েও গেছে।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘সোনার বাংলা ট্রেন মেইন লাইনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেইন লাইনের সাথে আপলাইন পরিবর্তন না করায় এ ঘটনা ঘটে। কারণ সোনার বাংলা ট্রেনটি দ্রুত গতিতে আসছিল।’

দুর্ঘটনায় আহত সাঈদুর রহমান জানান, ইফতার করার পর হাত ধোয়ার সময় হঠাৎ বিকট শব্দ হয় এবং বগিগুলো একটার উপর আরেকটা উঠে যায়।’

দুর্ঘটনায় আরেকজন আহত ও যাত্রীবাহী ট্রেনটিতে থাকা পুলিশ সদস্য তানভীর জানান, ‘ইফতার করার পর আমরা বসিছলাম হাত ধুইতে। এর মধ্যে একটা ধাক্কা লেগে বিশাল আওয়াজ হইছে। তখনই বুঝে গেছি ট্রেন মনে হয় লাইনচ্যুত হইছে। ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু কেমন যেন দুমড়েমুচড়ে উল্টে গেল। আমরা যারা সামনে ছিলাম তাদের অনেকেই আহত হয়েছি।’

ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন আহতদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠায়। কয়েকজনকে শাহ আলী বাসে করে কুমিল্লার দিকে পাঠানো হয়।

দুর্ঘটনার খানিক বাদে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় নাঙ্গলকোট রেলওয়ের এক কর্মচারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিগন্যাল ঠিক না করায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। যে লাইনে মালগাড়িটি আছে, সেই লাইনে যাত্রীবাহী ট্রেন কীভাবে ঢোকে? স্টেশন কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’

হাসানপুর স্টেশনের একজন কর্মচারীর বরাত দিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাকসাম রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পয়েন্টিং ভুলের কারণে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস মূল লাইন দিয়ে না গিয়ে লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে। তখন লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ৬০১ আপ বিএফসিটি কনটেইনার ট্রেনকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় সোনার বাংলা। ফলে সোনার বাংলার পাওয়ার ৩০১৫ ইঞ্জিন ও কনটেইনার ট্রেনের ৬০১ ব্রেকভ্যান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

নাঙ্গলকোট রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার জামাল হোসেন দুর্ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘এ ঘটনার পর কুমিল্লা ও লাকসাম থেকে রেলওয়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন। চট্টগ্রাম থেকে একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে রওনা দিয়েছেন।’

দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন লাকসাম রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জসিম উদ্দিন খন্দকার। তিনি বলেন, ‘এখানে এসে উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছে সবাই। এখনো রিলিফ ট্রেন এসে পৌঁছায় নাই। তবে ফায়ার সার্ভিস এসে ইতোমধ্যে তাদের কাজ শুরু করেছে।’

স্টেশন মাস্টারসহ কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর স্টেশনে দুর্ঘটনার পরে না থাকা বিষয়টি স্বীকার করেন জসিম উদ্দিন খন্দকার। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা এসে এখানে তাদের কাউকে দেখিনি। তবে একটু আগে তারা দেখলাম এসেছে। আমরা আসলে সবাই মাঠে কাজে ব্যস্ত। আর তাই কারও না থাকার বিষয়টি সেভাবে নজরে আসে নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে চারটি লাইনের মাঝে একটি ওকে হয়ে গেছে। আমরা একটু আগে চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনকে এখানে থেকে পার করে দিয়েছি। রিলিফ ট্রেন আসলে বাকিকাজও খুব দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করছি।’

প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ১০জন ইতোমধ্যেই ফিরে গেছে বলেও জানান লাকসাম রেলওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান মেহেবুব বলেন, ‘আমরা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মাত্র রেলস্টেশনে এসেছি। এই দুর্ঘটনায় যাত্রীবাহী সোনার বাংলা ট্রেনের অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢালুয়ার একটি ফার্মেসিতে প্রায় ২০ জন যাত্রী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। আহত অন্যান্যদের উদ্ধার করে লাকসাম ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।’

দুর্ঘটনার পর কোথায় ছিলেন?- জানার জন্য হাসানপুর স্টেশনের মাস্টার সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। স্টেশনে তার নির্ধারিত কক্ষে গেলেও সেখানে তিনি ছিলেন না। এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামিম আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে, রেলওয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক আবিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যেই সোনার বাংলা ট্রেনের বগি লাইনচ্যুতের ঘটনা তদন্তের জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের পরিবহন কর্মকর্তা তারিক ইমরানকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই তদন্ত কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

কুমিল্লা ট্রেন দুর্ঘটনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর