Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুনত্ব এলেও সংকট কাটছে না টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পে

মহিউদ্দিন সুমন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৫৫

টাঙ্গাইল: শাড়িতেই গৃহস্থলী, শাড়িতেই উৎসব। আধুনিকতার ছোঁয়াতেও শাড়ির প্রতি বাঙালি নারীদের রয়েছে দুর্বলতা। বর্ষবরণ কিংবা ঈদ, পূজা কিংবা বসন্তবরণ- যেকোন উৎসবে নারীদের চাই নতুন শাড়ি। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির প্রতি রয়েছে নারীদের অন্যরকম আকর্ষণ। প্রতিবছরের মতো এবারও টাঙ্গাইল শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব। বাহারি ডিজাইনের শাড়িতে রয়েছে ঋতু পরিবর্তনের ছোঁয়াও। আর এসব শাড়ি কিনতে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীগুলোতে ভিড় করছে ক্রেতারা। শাড়ির বাজারের সঙ্গে ঘোরে এখানকার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকা। অথচ ঈদের বাজারেও সংকটে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প।

জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডী-পাথরাইল ও পুটিয়াজানিসহ অন্তত ১৫টি গ্রামে পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী। শাড়ির চাহিদা মেটাতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন তাঁত শ্রমিকরা। সুতি, জামদানি, সফটসিল্ক, ধানসিঁড়ি, বালুচুরি, গ্যাসসিল্ক, স্বর্ণকাতান ও দোতারির মত নানা ডিজাইনের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে এসব তাঁতপল্লীতে।

প্রতিবছরের মত এবার ঈদেও শাড়ির রং আর ডিজাইনে এসেছে বৈচিত্র্য। এসব শাড়ি দেশ ও দেশের বাইরের খুচরা ও পাইকারি ক্রেতারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প দেশের অন্যতম পুরনো কুটিরশিল্প। এ অঞ্চলের তৈরি তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এখানকার মানুষের রুজি-রোজগারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে এ শিল্প। সুঁতো কাটা থেকে তানা সাজানো, শাড়ি বানানো থেকে শাড়ি বিক্রি পর্যন্ত সম্পৃক্ত তাঁত পল্লীর অধিকাংশ মানুষ।

নব্বই দশকের হিসেব অনুযায়ী টাঙ্গাইলের কুটির শিল্পের তাঁতগুলো তাঁতিদের বাড়ির অভ্যন্তরে বসানো হয়। এর মধ্যে ৭২শতাংশ পাঁচটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত, ১১শতাংশ তাঁত ছয় থেকে দশটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং ৬ শতাংশ তাঁত এগারো থেকে বারোটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং অবশিষ্ট ১১শতাংশ বারোটির অধিক তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত।

১৯৯২ সালের হিসেব অনুযায়ী টাঙ্গাইল জেলায় ১ লাখের বেশি তাঁত ছিল এবং তাঁতীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার। ২০০৮ সালে এক লাখ ছোট বড় কারখানায় ৩৭২২২টি তাঁত এবং ৭০ হাজার তাঁতী ছিল।

২০১৩ সালের শুমারিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী টাঙ্গাইল জেলায় ওই সময়ে ৬০০০০ তাঁত ছিল। এর মধ্যে ৮৩০৫টি পিট তাঁত, ৫১১৪১টি চিত্তরঞ্জন তাঁত এবং ৮৯২টি পাওয়ারলোম তাঁত। সেই ঐতিহ্যবাহী তাঁতের সংখ্যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৪০২টি। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শিল্পটি। দফায় দফায় সুতার দাম বৃদ্ধি, করোনাভাইরাস এবং কারিগরের অভাবে এ শিল্প হুমকির মুখে।

সাধারণত শাড়ির চাহিদা মেটাতে রমজান জুড়ে থাকে তাঁতের খঁটখঁটি শব্দ। তাঁতপল্লীর বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে থাকে সারি-সারি গাড়ি। অথচ ঈদ ঘনিয়ে এলেও এবারে নেই সেই পুরনো চিত্র। জেলার একমাত্র পাইকারি শাড়ির হাট করটিয়ার চিত্রও একই। মধ্যম দামের সুতি জামদানি শাড়ির চাহিদা থাকলেও অন্যান্য শাড়ির চাহিদা অনেক কম।

শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত একবছরে একশ’ শতাংশের বেশি সুতার দাম বেড়েছে। খরচ কমাতে চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ার লোমে শাড়ি উৎপাদন হচ্ছে। কম খরচে একই ধরণের শাড়ি পাওয়ায় হস্তচালিত তাঁতশিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

তাঁত বোর্ডের তথ্য মতে, জেলায় তাঁতের সংখ্যা কমে ৩৪ হাজার ৪০২টিতে দাঁড়িয়েছে। তাঁত মালিকের সংখ্যা ৪ হাজার ১৫১ জন। এ তাঁতপল্লীতে কেউ শাড়ি বুনেন, কেউ চরকায় সুতা কাটেন, কেউ কাপড়ের নকশার সুতা কাটেন। আবার সুতা রঙ করা, শুকানো, পাটি করা, তানার সুতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার কাজ করে থাকে এ পেশায় সম্পৃক্তরা।

স্থানীয় অধিকাংশ তাঁতি ইতোমধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে যমুনার চরাঞ্চল ও সিরাজগঞ্জের কারিগররা টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীর হাল ধরেছে। এসব এলাকা থেকে প্রায় আড়াইশ’ কারিগর এসে তাঁতপল্লীতে তাঁতের কাজ করছেন।

কাতুলী থেকে আসা বুদ্দু মিয়া, জব্বার হোসেন ও সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মোন্তাজ আলী, আবু তাহের, আলম, হোসেন আলী ও রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। এসব কারিগররা জানান, হস্তচালিত তাঁত বিলুপ্তির পথে। অধিকাংশ কারিগর চিত্তরঞ্জনে চলে গেছে। অনেকে পাওয়ারলোমেও চলে গেছে। হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বানাতে সময় বেশি লাগে। শাড়ি বানিয়ে যা উপার্জন হয় এতে সংসার চলে না। কিন্তু পাওয়ার লোমে অল্প সময়ে বেশি শাড়ি বানানো যায়। ফলে কারিগররা পাওয়ারলোম ও চিত্তরঞ্জন তাঁতের দিকে ঝুঁকছেন।

প্রবীণ তাঁতি সচীন রাজবংশী বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ির অবস্থা ভালো না। কারিগর পাওয়া যায় না। হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বানাতে বেশি সময় লাগে। সে অনুযায়ী কারিগরদের মজুরি দেওয়া যায় না। ফলে কারিগররা চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ার লোমের দিকে ঝুঁকছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মহাজনদের কাছ থেকে সুতা, তানা এনে কারিগর দিয়ে শাড়ি বানাই। শাড়ি তৈরি করে মহাজনদের দেই। তারাই বিক্রি করেন। সেক্ষেত্রে আমরা মজুরি পাই। ইচ্ছে করলেই আমরা কারিগরদের মজুরি বাড়াতে পারি না।’

শাড়ি ডিজাইনার ও শাড়ি ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির মূল ব্যবসা ঈদ-পূজাকে কেন্দ্র করে। সারাবছর ব্যবসা ধরে রাখা হয়। ঈদ বা পূজাকে ঘিরে সারাবছরের উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি শেষ হয়। ঋতু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে এ বছর রঙ আর কাপড়ে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে শাড়িতে নতুনত্ব আর বৈচিত্র আনা হয়েছে। আর দামও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীর শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, এ বছর সুতার দাম ১০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। মধ্যম দামের শাড়ির বিক্রয় মূল্য বাড়লেও অন্যান্য শাড়ি আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। আমার ধারণা ঈদ কাছিয়ে আসার সাথে সাথে শাড়ি বিক্রি বাড়বে। এটা দেশের অন্যতম কুটির শিল্প। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

করটিয়া মেসার্স তানিয়া বস্ত্রালয়ের মালিক মো. শাহজাহান আনছারী জানান, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের লকডাউনে অসংখ্য কারিগর বেকার হয়ে পড়েন। বেঁচে থাকার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যান তাঁতিরা। এরপর ২০২০ সালের বন্যায় জেলার তাঁতশিল্প আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরইমধ্যে সুঁতা, রঙ, রাসায়নিক কেমিক্যালসহ কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়ে তাঁতিরা। তাই সরকারে উচিত স্বল্প সুদে তাঁতিদের ঋণ সহায়তা দেওয়া।

সদর উপজেলার বাজিতপুর বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, তার কার্য এলাকায় সাড়ে পাঁচ হাজারের উপরে পিটলুম রয়েছে। এখানেই মূলত ঐতিহ্যবাহী ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ উৎপাদন হয়ে থাকে। ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির ৩০৫জন তাঁত মালিকের মধ্যে তাঁত শিল্পের আধুনিকায়ন ও চলতি মূলধন হিসেবে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। দেয় ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার ৬০ শতাংশ। একজন তাঁত মালিক ঋণ নিয়ে সুষ্ঠু ব্যবহার করলে তাঁত শিল্পের পাশাপাশি তাঁতিদেরও উন্নয়ন হবে বলে মনে করেন তিনি।

সারাবাংলা/এমও

টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প তাঁতশিল্প


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ভূতের গলির বাসায় মিলল বৃদ্ধের মরদেহ
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:০০

সম্পর্কিত খবর