ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে উত্তরে নতুন, পুরনোতেই আস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটির
১৮ এপ্রিল ২০২৩ ১০:৪৯
ঢাকা: গত বছর থেকে শুরু হওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে এবছরও। তাই চলতি বছর শুরু থেকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পুরনো পদ্ধতিতে ভরসা রাখলেও ঢাকা উত্তর হাতে নিয়েছে নতুন কর্মসূচি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. ফজলে শামসুল কবীর বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন বর্ষাকালে সীমাবদ্ধ নেই। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এমনকি মার্চেও এখন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাই আমরা বছরব্যাপী ডেঙ্গু নিধন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি যা বছরের শুরু থেকেই চলছে। ঈদের পর এটি আরও ব্যাপকভাবে শুরু হবে।’
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে নিয়মিত সকালে লার্ভিসাইডিং ও বিকেলে ফগিং করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি আমরা মানুষকে সচেতন করতে বেশি জোর দিচ্ছি। চলতি বছর দুইশর বেশি স্কুলে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করেছি। স্কুলের ছেলেমেয়েসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে লিফলেট বিতরণ করছি। মাইকিংয়ের মাধ্যমেও সচেতন করা হচ্ছে। যেহেতু ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা ঘরের ভেতরে জন্মে তাই মানুষ সচেতন না হলে সিটি করপোরেশনের পক্ষে প্রতিটি বাড়ির ভেতরে ঢুকে কাজ করা সম্ভব না।’
মশার ধরণ বুঝে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে কিনা বা ভবিষ্যতে এটি করার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়রের নেতৃত্বে বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত কমিটি রয়েছে যারা ঠিক করে কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বছরে দুইবার আমরা সভায় বসে কোন কোন কীটনাশক কোন কোন সময়ে ব্যবহার করবো সেই সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের কীটনাশক সম্পূর্ণভাবে কাজ করছে, তাই আপাতত আমরা ওষুধ পরিবর্তন করছি না। জিগাতলা, কামরাঙ্গিরচর, খিলগাঁও, বাসাবো এলাকায় গতবছর রোগী বেশি ছিল তাই এ বছর এসব এলাকায় আলাদা করে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।’
তবে মশার ধরন নিয়ে কোনো গবেষণা করছে না ডিএসসিসি। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘যেহেতু আমাদের নিজস্ব গবেষণাগার নেই, তাই আমরা বাইরের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে কাজ করছি। চলতি বছর আমাদের এখানে (ডিএসসিসি এলাকায়) রোগী খুবই কম। একজন, দুজন করে পাওয়া গেছে। যেহেতু আমাদের বর্তমান কার্যক্রম ফলপ্রসূ তাই আমরা সহসাই এটি পরিবর্তন করছি না।’
অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘আমরা এবার মশক নিয়ন্ত্রণের স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনেছি। আমরা ফগিংয়ে কিছুটা কম গুরুত্ব দিয়ে লার্ভিসাইডিংয়ে বেশি মনযোগ দিচ্ছি। এছাড়া লার্ভিসাইডিংয়ের সময়টাও বদলে দিয়েছি। আগে সকাল আটটা থেকে শুরু হলেও বর্তমানে আমরা সকাল ছয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত করছি। ভোরবেলায় সবচেয়ে কার্যকরীভাবে লার্ভিসাডিং করা যায়, তাই এই পদ্ধতি হাতে নিয়েছি আমরা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডের ১৯৬ বর্গকিলোমিটার জুড়েই চলছে লার্ভিসাইডিং।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া মশার বায়োলজিক্যাল নিয়ন্ত্রণের জন্য বিটিআই বা ব্যাসিলাস টুল জিএমসি নামক নতুন একধরনের ওষুধ ব্যবহার করছি। এছাড়া নোভালুরন নামক চতুর্থ প্রজন্মের লার্ভিসাইড ওষুধ ব্যবহার করছি আমরা। একেকটি নোভালুরন বড়ির কার্যকারিতা প্রায় ৯০ দিন। পাশাপাশি সব লেকে গাপ্পি মাছও ছেড়েছি আমরা। এসবের পাশাপাশি ঈদের পর সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা হবে। বর্তমানে লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।’
এছাড়া মশার ধরন নির্ধারণের জন্য গবেষণা কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মশা নিয়ে গবেষণার একটি প্রস্তাব দিয়েছে, সেই প্রস্তাবনা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে অনেক কার্যক্রমই এখন শুরু হয়েছে। যেমন তাদের ল্যাবে টেস্ট করেই বিটিআইয়ের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে ব্যবহার করছি। চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সফল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই কর্মকর্তা।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে ৯০১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এসময়ে মৃত্যু হয়েছে দশ জনের। আর গত বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে রেকর্ড ২৮১ জনের মৃত্যু হয়।
এক জরিপে জানা গেছে, রাজধানীর ৩৯.৮ শতাংশ বহুতল ভবন এবং ৩২ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার চেয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এডিস মশার উপস্থিতি কিছুটা বেশি পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত বর্ষাকাল পরবর্তী জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ১০৮টি ওয়ার্ডে এই জরিপ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ডিএনসিসির ৪০টি এবং ডিএসসিসির ৫০টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৫০টি বাড়িকে জরিপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এসময় ১২৭টি বাড়িতে এডিস মশা পাওয়া গেছে; যা শতকরা ৪.০৩ শতাংশ। যেসব বাড়িতে মশা পাওয়া গেছে তার মধ্যে ৩৯.৮ শতাংশ বহুতল এবং ৩২ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবন। উভয় সিটি করপোরেশনের মধ্যে উত্তরে শতকরা ৩.৮ শতাংশ বাড়িতে মশা পাওয়া গেছে। দক্ষিণ সিটি এলাকায় এই হার ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
কোনো এলাকায় এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। এই ইনডেক্স ২০ এর বেশি হলেই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়। ঢাকা উত্তর সিটির কোনো ওয়ার্ডে মশার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ পাওয়া যায়নি। ৩, ২৩, ২৬ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ছিল ১০ এর বেশি। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকার ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। এছাড়া ২, ১৬ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রটো ইনডেক্স ১০ এর বেশি পাওয়া গেছে।
এর আগে ৯ এপ্রিল সচিবালয়ে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে প্রথম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলে ধরে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮৭৫ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন থেকে সারা বছর ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগে কয়েক মাস যেমন এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। এখন ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হচ্ছে।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগের সভায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করবো। তবে এই সময়গুলোতে পিক সিজন ও লিন সিজন ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ এডিসের জন্য একটি উর্বর সময়, অন্যটি অনুর্বর মৌসুম। আমরা সেই অনুসারে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’
সারাবাংলা/আরএফ/এমও
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ঢাকা দক্ষিণ সিটি সিটি করপোরেশন