‘কী কী বললে ধর্মীয় অনুভূতিতে লাগে— তালিকা দিন’
১৯ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কোন শব্দ উচ্চারণ করলে, কী কী বললে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে— সরকারের কাছে এমন একটি তালিকা তৈরির দাবি জানানো হয়েছে চট্টগ্রামের এক নাগরিক সমাবেশ থেকে।
কবি-শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সেলিনা আক্তার শেলীকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হুমকিধমকি ও হেনস্থা বন্ধের দাবিতে রোববার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও নাগরিক সমাবেশ থেকে এ দাবি এসেছে। নগরীর চেরাগি চত্বরে ‘সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ’র ব্যানারে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, ‘সরকারের কাছে, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছে আমার উদাত্ত আহ্বান, আপনারা ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী সেটা আমাদের জানান। কোন কোন শব্দ বললে, কোন কথা বললে, কী কী বললে, কোন আচরণ করলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে সেটার একটা তালিকা আমাদের দেন। আমরা সেটা ঘরের দেয়ালে, পড়ার টেবিলে, বাসার দরজায় ঝুলিয়ে রাখব; যেন প্রতিমুহূর্তে আমাদের চোখে পড়ে। তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, এই শব্দগুলো উচ্চারণ করলে, এই কথা বললে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে।’
সেলিনা শেলীর দেওয়া ফেসবুক পোস্টের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছিল হিন্দুয়ানি বলে, যেন এই শব্দ বোধহয় ঘৃণ্য, পরিত্যক্ত কিছু। বাংলা ভাষার মধ্যে আবার হিন্দু-মুসলিম আসবে কেন? সেই পটভূমিতে সেলিনা শেলী লিখেছিলেন। আজ সেই লেখার কারণে তার বাড়ির চারপাশে অসংখ্য হায়েনার আনাগোনা শুরু হয়েছে, পেলেই যেন তার কল্লা কেটে নেবে। এমন অনিরাপদ বাংলাদেশ আমরা চাইনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে মানুষের মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করা হচ্ছে। এই আইন এখন ব্লাসফেমি আইনে পরিণত হয়েছে। এই আইন অবিলম্বে বাতিল চাই।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সেলিনা আক্তার শেলী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কবি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার মঙ্গল শব্দকে ‘হিন্দুয়ানি’ বলার বিরোধিতা করে তিনি ‘রামাদান’ শব্দ উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এরপর থেকে তাকে নানাভাবে আক্রমণ শুরু হয়। এই পোস্টের জেরে গত ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন।
সেলিনা শেলীর চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সেলিনা শেলী বিশাল সময়ের শিক্ষকতা জীবনে তার বিরুদ্ধে কখনো কেউ কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। ঠুনকো একটি বিষয়, ফেসবুক পোস্ট নিয়ে তার বিরুদ্ধে বন্দর কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। তাকে স্বপদে বহাল করতে হবে। তার যে সম্মানহানি হয়েছে, সেটা যাতে পুনরুদ্ধার হয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা উসকানি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে সরকারকে বিরুদ্ধে লাগানোর চেষ্টা করছে অভিযোগ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে আমি একবার গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের গণকবরগুলো দেখতে। একটি গণকবরের উপর রাস্তা হয়ে গেছে, তার কোনো চিহ্ন নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখেনি। আমি বন্দর কর্তৃপক্ষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই।’
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘এদেশে একটি শব্দ উচ্চারণের পর আমাকে দ্বিধায় থাকতে হয় যে, আমি কোনো ষড়যন্ত্রে পড়ে যাই কি না। আমরা কথা বলতে পারব না, আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারব না, এমন বাংলাদেশ তো বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে যাননি। বন্দরের যে কুলাঙ্গাররা স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সেলিনা শেলীর গলা কাটার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। আমাদের কণ্ঠ কেউ থামাতে পারবে না। আমরা কথা বলে যাব।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘সামনে নির্বাচন, সেজন্য ধর্মান্ধ জামাতি, রাজাকার-আলবদররা আবার মাথা তোলার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।’
আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহা, কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, শিক্ষক হোসাইন কবির, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী, কবি রাশেদ রউফ, সাংস্কৃতিক সংগঠক শীলা দাশগুপ্ত, কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার, কবি অভীক ওসমান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান, উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অসীম বিকাশ দাশ, বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি প্রনব চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল।
ছাত্র ইউনিয়ন
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সেলিনা শেলীর সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে অবিলম্বে স্বপদে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়ে সমাবেশ করেছে জেলা ছাত্র ইউনিয়ন। বুধবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ইমরান চৌধুরী। জেলার শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ আবছারের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সভাপতি রিপায়ণ বড়ুয়া, জেলার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তানভীর ইলাহী, সহ-সভাপতি অয়ন সেন গুপ্ত, সাংগঠনিক সম্পাদক শুভ দেবনাথ ও সাবেক সভাপতি এ্যানি সেন।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, কবি সেলিনা শেলী ফেসবুকে দেওয়া পোস্টের মাধ্যমে কোনোভাবেই ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেননি। পবিত্র রমজান মাসের বিরুদ্ধেও তার কোনো বক্তব্য সেই পোস্টে ছিল না কিংবা ধর্মীয় মনীষীদের নিয়েও কোনো কটূক্তি তিনি করেননি। এরপরও তিনি যেভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন, এটি একজন নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি চরম অন্যায় আচরণ বলে আমরা মনে করি। আমরা অবিলম্বে সেলিনা শেলীকে হয়রানি থেকে রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ চাই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চাই।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম