এখনই সরকারি অনুদানের টাকা পাচ্ছেন না বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা
২০ এপ্রিল ২০২৩ ১০:২৭
ঢাকা: বঙ্গবাজারের পুড়ে যাওয়া মার্কেটের খোলা জায়গায় অস্থায়ী দোকান বসিয়ে ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন সর্বস্ব হারানো ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ঈদের আগে সরকারি অনুদানের অর্থ হাতে পাচ্ছেন না তারা।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তাদের অ্যাকাউন্টে এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা জমা আছে। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে এই অর্থ পাওয়া গেছে। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে দুই কোটি টাকার চেক পাওয়া গেছে, যা এখনও ভাঙানো হয়নি। মেয়র পরবর্তীতে আরও এক কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঈদের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর কাছে এই অর্থ তুলে দেওয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসসহ বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীনসহ সংশ্লিষ্টরা বসে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে ঈদের পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাতে এই টাকা তুলে দেবেন বলে জানা গেছে।
গত ৪ এপ্রিল সকালে আগুন লাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ঐতিহাসিক বঙ্গবাজার মার্কেটে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মার্কেটের ৪টি ইউনিটের (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, মহানগর কমপ্লেক্স, গুলিস্তান কমপ্লেক্স এবং আদর্শ ইউনিট) ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার ৩৭০টি দোকান। এতে রাতারাতি পথে বসে যান প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসায়ী।
আগুন লাগার পর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। গত ১২ এপ্রিল ইট বিছিয়ে অস্থায়ী দোকান করে ব্যবসা করার সুযোগও করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোন সাহায্য নয়, নিজ উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। একাধিক ব্যবসায়ী প্রতিবেদককে জানান, শূন্য থেকে শুরু করে লাখ বা কোটি টাকার ব্যবসা দাঁড় করালেও এখন আবারও শূন্য থেকেই শুরু করতে হচ্ছে তাদের। ঈদের আগে অর্থ সাহায্য পেলে তাদের জন্য ব্যবসা করা সহজ হত। অর্থ সাহায্য ও দোকান পেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবেন সেই আত্মবিশ্বাস তাদের আছে। এখন ঈদের পর প্রতিশ্রুত অর্থ তারা পাবেন বলে আশা করছেন।
ইট বিছানো অস্থায়ী বাজারে কাঠের খাট পেতে অল্প কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে বসেছেন কয়েকশ’ ব্যবসায়ী। তেমনই একজন লক্ষ্মীপুরের মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় একটি ব্যাংক থেকে ২৭ হাজার টাকা লোন নিয়ে বঙ্গবাজারে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। আগুন লাগার আগে তার দোকানে ষাট থেকে সত্তর লাখ টাকার মালামাল ছিল। শনির আখড়ার বাসা থেকে ছুটে আসতে আসতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় দু’টি দোকান ও গোডাউনের সব কাপড়। এখন বাকিতে পাঁচ হাজার টাকার গেঞ্জি এনে আবারও শুরু করেছেন তিনি।
তিন সন্তানসহ পাঁচজনের পরিবার আনোয়ার হোসেনের। দোকানে কর্মচারী তিন জনকে বেতন দিতেন চল্লিশ হাজার টাকা। একসময়ের লাখপতি আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে কেউ সাহায্য দেয়নি, আমি কারও কাছে যাইনি। টাকার জন্য তো মানুষের পেছন পেছন ঘুরতে পারি না। সরকার খালি আমাদের এখানে বসার সুযোগ করে দিক, তিন মাস লাগবে ঘুরে দাঁড়াতে।’
আগুন লাগার আগে দু’টি দোকানে তিরিশ লাখ টাকার বাচ্চাদের পোশাক ছিল মোহাম্মদ অপুর। ঈদ উপলক্ষে কিছু লোন ও নিজের কিছু টাকা দিয়ে মাল তুলেছিলেন। বছর পাঁচেক আগে বিশ লাখ টাকা দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। তার আগে চাকরি করতেন। এলাকার কিছু মানুষের বঙ্গবাজারে ব্যবসা ছিল, যা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের কিছু টাকা ও ব্যাংক লোন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া হাজার বিশেক টাকা দিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় খাটের উপর ছাতা মেলে আবারও মাল তুলেছেন অস্থায়ী দোকানে।
কিন্তু কোনো অর্থ সাহায্য পাননি অপু। তবে কাস্টমার আসছেন। পুরনো কাস্টমাররা এসে অনেকে বাড়তি টাকাও দিচ্ছেন। তাছাড়া পাইকারি ব্যবসায়ীরাও তাদের মালামাল দিচ্ছেন, তাই এখানে বসার সুযোগ পেলে আবারও শতভাগ ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করেন তরুণ এই ব্যবসায়ী।
বঙ্গবাজার অস্থায়ী মার্কেটের সামনে রাস্তার পাশে একটি করে সেলাই মেশিন নিয়ে বসে ছিলেন মোহাম্মদ উজ্জ্বল এবং আবুল হোসেন। আগে মার্কেটের ভেতর গলির মধ্যে বসে কাজ করতেন তারা। উজ্জ্বল হোসেনের মেশিন ছিল দু’টি আর আবুল হোসেনের ছিল তিনটি।
মেশিন ও অন্যান্য জিনিসপত্র সবই পুড়ে গেছে তাদের। ফলে তাদেরও শুরু করতে হচ্ছে একদম শূন্য থেকে। এক টাকাও সাহায্য পাননি তারা। ধারদেনা করে দুজন দু’টি সেলাই মেশিন কিনে বসেছেন রাস্তার পাশে। তাদের মতো এমন আরও আট থেকে দশজন ছিল। আগে দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হলেও এখন দিনে তিন থেকে চারশ টাকা আয় হচ্ছে তাদের। তারাও অর্থ সাহায্য ও ব্যবসা করার টাকা পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন।
মার্কেটের মসজিদে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে চাকরি করতেন আবদুল মাজিদ। বিশ বছর ধরে সঞ্চয় করে মসজিদের পাশে একটি বিকাশ, ফ্লেক্সিলোড, ও হালকা খাবারের দোকান দিয়েছিলেন। দোকানে তিন লাখ টাকার ক্যাশ ছিল বিকাশ লেনদেনের। সব পুড়ে ছাই। সঞ্চয় পুড়ে যাওয়ায় বর্তমানে পরনের পাঞ্জাবি ছাড়া আর কিছুই নাই তার। এদিকে বিকাশ থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। অসুস্থ ও দুই সন্তান মিলিয়ে পাঁচজনের সংসার। প্রতি মাসে মায়ের জন্য তিন হাজার দুইশ টাকার ওষুধ লাগে। বর্তমানে কোনরকমে টিকে আছেন তারা। এই মুহূর্তে তার দরকার নগদ অর্থ সাহায্য যা দিয়ে তিনি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক টাকাও সাহায্য পাননি কোথাও থেকে।
এদিকে গতকাল বুধবার (১৯ এপ্রিল) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ জন দোকান মালিককে নগদ এক লাখ টাকা সহায়তা দেয়। জেলা প্রশাসনের সহায়তা ও সমন্বয়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে এই অর্থ দিয়েছেন। বঙ্গবাজারের অগ্নি দুর্ঘটনার সময় দুই কোটি টাকার আগুনে পোড়া কাপড় কিনে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল তারা। ঈদের পর বাকি এক কোটি টাকা হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
এছাড়া বুধবার মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) পক্ষ থেকে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪২ জন ব্যবসায়ীকে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ঈদের আগে ব্যবসা করতে তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকার নগদ চেক তুলে দেওয়া হয়।
এর আগে, গত ৯ এপ্রিল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে এক কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
এছাড়া ৯ এপ্রিল সারা বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বঙ্গবাজারের আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ২০ লাখ টাকা সাহায্য দেওয়া হয়। পাশাপাশি কুমিল্লা থেকে ২৬ লাখ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মীদের এক দিনের বেতন ২ লাখ টাকাসহ মোট অর্ধ কোটি টাকার মতো অনুদানের অর্থ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সারাবাংলা/আরএফ/এমও