Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৭ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বিজয়পুরের সাদামাটি উত্তোলন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:২৩

নেত্রকোণা: দীর্ঘ ৭ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশে নেত্রকোণা সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুরে অবস্থিত সাদা মাটি উত্তোলন। নেত্রকোনায় মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন কররায় সাদা মাটিকে ২০১৭সালে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই পণ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবু সাদা মাটি উত্তোলন আদিবাসী গারোদের বাসস্থান হুমকির মুখে পড়ে বিধায় দীর্ঘদিন ধরে উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জেলার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর উপজেলার ‘বিজয়পুরের সাদামাটি’ ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন প্রোডাক্ট বা জিআই পণ্য) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) ভৌলোলিক পণ্য ইউনিট আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস্ অর্গানাইজেশনের নিয়ম মেনে এই স্বীকৃতি দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ২০১৭ সালে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক অত্যন্ত মূল্যবান ও দুর্লভ খনিজ সম্পদ হিসেবে পরিচিত বিজয়পুরের সাদামাটিকে ভৌগোলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতরে (ডিপিডিটি) আবেদন করেন। অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর পণ্যটির স্বীকৃতি মিলে। গত ১৭ জুন নেত্রকোণার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সুহেল মাহমুদ ডিপিডিটি কার্যালয় থেকে নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করেন।

দেখা গেছে, বিজয়পুরের সাদামাটি অত্যন্ত মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য একটি খনিজ সম্পদ। সাধারণত সিরামিকের তৈজসপত্র, টাইলস্, স্যানিটারি ওয়্যার ও গ্লাস তৈরির ক্ষেত্রে এ মাটি ব্যবহৃত হয়। উৎকৃষ্টমানের এ মাটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি প্রাকৃতিকভাবেই কেওলিন বা অ্যালুমিনিয়াম সমৃদ্ধ। অনেকে এটিকে চিনামাটিও (চায়না ক্লে) বলে থাকেন।

দুর্গাপুর উপজেলার ভারত সীমান্ত সংলগ্ন কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বিজয়পুর এলাকায় এ মাটির খনি অবস্থিত। এই খনিজ এলাকাটি মূলত গারো পাহাড়ের অন্তর্গত একটি টিলাবেষ্টিত এলাকা। এর খুব কাছেই ভারতের সীমানায় রয়েছে সুউচ্চ গারো পাহাড়। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর ১৯৫৭ সালে দুর্গাপুরের ভেদিকুড়া নামক স্থানে প্রথম এ সাদামাটির সন্ধান পায়। ওই সময়ে (১৯৫৭) পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রশস্ত এই খনিজ অঞ্চলে প্রায় ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন সাদামাটি রয়েছে।

১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে বিজয়পুর এলাকায় ১৩টি কূপ খনন করে মাটি তোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু হয় মাটি তোলার কাজ। এর পর থেকে প্রতিবছর ১০-১২টি কোম্পানি খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে ইজারা নিয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাদামাটি আহরণ করে। তবে অসংখ্য কোম্পানি নির্বিচারে সাদা মাটি উত্তোলন করার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে আদিবাসী গারোদের জীবন ও বসত বাড়ি।

এজন্য ২০১৫ সালে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বেলা’ সাদামাটি আহরণের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে আদালতে মামলা দায়ের করে। সে প্রেক্ষিতে আদালত ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ মাটি তোলার কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয়। এ কারণে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে বিজয়পুরের খনিজ এলাকায় সাদামাটির তোলার কাজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে।

এদিকে বিজয়পুরের সাদামাটি খনিজ প্রকল্প এলাকাটি একটি পর্যটন এলাকা হিসেবেও পরিচিত। পাহাড়ি টিলা কেটে অনেক গভীর স্তর থেকে এ সাদামাটি তোলা হতো। পাশাপাশি সেখানে কালো, খয়েরি, বেগুনি ও নীলসহ আরও কয়েক রংয়ের মাটির স্তর রয়েছে। বর্তমানে খনন কাজ বন্ধ থাকলেও আগে খনন করা এলাকাগুলোতে গেলে নানা রংয়ের মাটির স্তর এখনও সুষ্পষ্ট দেখা যায় যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

আর খনন করা এলাকাগুলো পরিণত হয়েছে নীল পানির লেকে। লেকগুলো অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুদৃশ্য। প্রতিদিনই সেখানে দূর-দূরান্তের অগণিত পর্যটক ভিড় করেন। তবে রাস্তাঘাট খানাখন্দে ভর্তির কারণে বর্তমানে পর্যটকদের আনাগোনা কিছুটা কম। চলাচলের উপযোগী রাস্তা তৈরি করা হলে পর্যটক দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।থাকা খাওয়ার জন্য আধুনিক হোটেল মোটেল তৈরি করা হলে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাবে।

পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর (ডিপিডিটি) সূত্রে জানা গেছে, বিজয়পুরের সাদামাটির সঙ্গে বাংলাদেশের আরও চারটি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই পণ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল ও দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল। উল্লিখিত পাঁচটি পণ্যের তালিকা নতুন করে যোগ করায় দেশে এখন জিআই পণ্যের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯টি।

এর আগে ২০১৬ সালে প্রথম জামদানি, ২০১৭ সালে ইলিশ, ২০১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতি আম ও ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিন জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।

কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই পণ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জিআই পণ্য একটি দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি পায়। এর ফলে পণ্যটিকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এই পণ্যগুলোর বিশেষ কদর থাকে। ওই দেশ বা অঞ্চল পণ্যটিকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার আইনি অধিকার রাখে।

তবে দীর্ঘদিন ধরে সাদা মাটি উত্তোলন করা হলে ও স্থানীয়ভাবে কোনো জিনিসপত্র তৈরি করা হয়নি। এলাকাবাসী জানান এলাকায় একটি কারখানা নির্মাণ করা হলে একদিকে সাদা মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতো এলাকা। অপরদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো এলাকার নর -নারীর। এগিয়ে যেতো আদিবাসী গারোদের জীবন যাপন ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘জিআই পণ্য হিসেবে বিজয়পুরের সাদামাটির স্বীকৃতি জেলার জন্য একটি বড় অর্জন। এই সাদামাটি এখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশের একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পণ্য হিসেবে পরিচিতি পাবে। আর এর মধ্য দিয়ে নেত্রকোনারও একটি আলাদা পরিচিতি গড়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। পর্যটকদের চলাচলের জন্য উপযোগী রাস্তা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’

সারাবাংলা/একে

নেত্রকোণা সাদামাটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর