বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট
৩০ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১৭
বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলায় গ্রীষ্মের শুরুতে বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানীয় জলের সংকট। বেশিরভাগ গ্রামবাসী এখন বাধ্য হয়ে পান করছেন ছোট ছোট খাল ও ঝিরি-ঝর্ণার দূষিত পানি। আবার সামান্য বৃষ্টি হলে ময়লা পানিতে ভরে যায় ঝিরি-ঝর্ণা আর খাল। এতে বছরে অধিকাংশ সময়ে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন তারা।
পাহাড়ি পল্লীগুলোতে বসবাসকারী মানুষজন প্রতিদিনই মাইলের পর মাইল পাড়ি দিচ্ছেন পরিবারের খাবার পানি যোগান দিতে। পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না তারা। খোদ সদর উপজেলার চিম্বুক এলাকায় শতাধিক পাহাড়ি পল্লীতে পানির জন্য হাহাকার বিরাজ করছে।
বর্তমানে বান্দরবান সদরসহ অন্য ৬টি উপজেলা রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে খাবার ও ব্যবহারের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তীব্র গরম ও পানির সংকটে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার সুয়ালয়ক ইউনিয়নের ১২টি ম্রো পাড়ার সাড়ে ৪ হাজার মানুষ ও টংকাবতী ইউনিয়নের ৭৩টি ম্রো পাড়ায় ১৩ হাজার ৪৫০ জন মানুষ তীব্র পানির সংকটে ভুগছেন।
গত বৃহস্পতিবার চিম্বুক সড়কে বিভিন্ন ম্রো পাড়া ঘুরে দেখা গেছে, পাড়ায় পাড়ায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। খাবার পানির খোঁজে তীব্র গরম উপেক্ষা করে মাইলের পর মাইল পাহাড়ি আঁকাবাঁকা ঢালু ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে দূর দূরান্তের ঝিড়ি-ঝর্ণাতে ছুটছেন তারা। কিন্তু ঝিরি-ঝর্ণাতেও পানি মিলছে না। পাহাড় ঘেমে ঝিরির গর্তে জমা হওয়া নোংরা পানি সংগ্রহ করছেন ম্রো নারীরা। তাও পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পানি পাচ্ছেন না তারা।
টংকাবতী চেয়ারম্যান পাড়ার বাসিন্দা পায়াং মুরুং জানান, সামন্য বৃষ্টি হলেই ঝিরির পানি ঘোলা হয়ে যায়। পাড়ায় পানির খুব অভাব আর অভাবের কারণে পাড়ার লোকজন বাধ্য হয়ে ঝিরির ঘোলা পানি ব্যবহার করছে। খাবার পানি পেতে হলে অনেক দূরের পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। নিচু পাহাড়ে নামতে অনেক কষ্ট হয়, নামলে আবার উঠতে আরেক কষ্ট। যার কারণে পাড়ার লোকজন ঝিরির ঘোলা পানি খাবারসহ নানা কাজে ব্যবহার করছে।
ক্রামাদি পাড়ার কাইসাং ম্রো জানান, পাড়া থেকে এক মাইল নিচে একটি ঝিরি রয়েছে, বর্তমানে সেখানেও পানি নেই। পাহাড় ঘেমে ঘেমে জমা হওয়া পানি সংগ্রহ করে তা বাড়ি নিয়ে যেতে খুবই কষ্ট হয় তাদের।
ঝিরিতে পানি নিতে আসা সাংরুই ম্রো ও কিশোরী রুইলো ম্রো জানান, অনেক দূর থেকে পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ পথ হেঁটে এখানে এসেছেন। ঝিরিতে পানি কমে গেছে। কয়েক ঘণ্টা লেগে যায় পাত্রগুলোতে পানি ভরাতে। পাহাড় ঘেমে যে পানি জমা হয়, সে পানি নিয়ে খুবই কষ্ট করে খাড়া পাহাড় পাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরতে কয়েক ঘণ্টা সময় চলে যায়।
ম্রো পাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান) পায়াং ম্রো বলেন, ‘চিম্বুক এলাকায় প্রায় ৮০টি ম্রো পাড়ায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানির জন্য মানুষ খুব কষ্টের মধ্যে পড়েছে গেছে।’
বিভিন্ন এলাকার একাধিক পাড়া কারবারিরা জানিয়েছেন, পার্বত্য জেলা পরিষদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ও এনজিও সংস্থাগুলোর উদ্যোগে নির্মিত রিংওয়েল, গভীর নলকূপ, পাতকুয়া এবং প্রাকৃতিক উৎস থেকেও বর্তমানে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
অপরদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় পাহাড়ি-বাঙালিরা অধিকাংশই দুর্গম পাহাড়ি জনপদে বসবাস করে। এসব মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে জেলা পরিষদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিভাগ ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা বিগত কয়েক বছরে কয়েক হাজার রিংওয়েল-নলকূপ খনন করে। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো রিংওয়েল-নলকূপ খননে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানি ওঠে না, অধিকাংশ কল অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। একটি রিংওয়েল বা নলকূপ দুই আড়াই শ ফুট গভীরে যাওয়ার কথা থাকলেও নামে মাত্র ৩০/৪০ ফুট। যা শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে কাজ করে থাকে ,যার কারণে শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই সেই সব কূপে পানি থাকে না।
বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম জানান, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে চাষাবাদ (জুম চাষ) নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও নানা ধরনের বনজ সম্পদ আহরণের ফলে পানির উৎস খ্যাত বিভিন্ন ঝিরি ও পাহাড়ি ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যায়। আর এসব কাজ বন্ধ করা না গেলে পানির উৎস শুকিয়ে অচিয়েই বিপর্যয়ে পড়বে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য।
বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী শর্মিষ্ঠা আচার্য বলেন, ‘পানি সমস্যার ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছি। অফিসের যে রিং টিউবওয়েলগুলো আছে সেগুলো আমরা সচল করে জনগণের ব্যবহারের উপযোগী করে তুলবো।’
সারাবাংলা/এমও