Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘গরিবের আবার মে দিবস কী’

রমেন দাশগুপ্ত ও ইমরান চৌধুরী
১ মে ২০২৩ ০৮:৩৭

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছেন শ্রমিক। ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটোকরেসপন্ডেন্ট।

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বৈশাখের আকাশে গণগণে সূর্য। প্রখর উত্তাপে যেন জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে প্রকৃতি! কাঠফাটা রোদ্দুরে পুড়ছে ফারুকের শরীর, তপ্ত পথে দগ্ধ হচ্ছে পায়ের পাতা। ঘর্মাক্ত শরীর জানান দিচ্ছে জীবনের ঘানি নিতে হচ্ছে টেনে। ফারুক পেশায় খালাসি শ্রমিক। কর্ণফুলী নদীর ঘাটে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে।

রোববার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে নগরীর সদরঘাটের আনু মাঝির ঘাটে লাইটার জাহাজ থেকে লবণ খালাস করছিলেন ফারুক। ঘামে ভেজা শরীরে চিকচিক করছিল লবণের সাদা দানা। মে দিবস আসে, মে দিবস যায়। অন্তঃত ৩০ বছর ধরে খালাসি শ্রমিকের কাজ করা ফারুকের জীবনে কী দিনটির বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে?

বিজ্ঞাপন

কাজের ফুরসতে সারাবাংলা প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ফারুকের। মে দিবস- কথাটা শুনে চোখ তুলে তাকায় ফারুক, কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা বিরক্ত। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মে দিবস, এটা কী ? কিসের মে দিবস ? আমরার আর মে দিবস কী? আমরা কাম করি, ভাত খাই। প্রতিদিন কম-বেশি কাম পড়ে, পেটে প্রতিদিন ভাত পড়ে না। পুরাদিন কাম পাইলে ৫০০ টাকা, না পাইলে ২০০-৩০০ টাকাও পাই। আর কাজ-কাম না থাকলে না খাইয়া শুইয়া থাকি।’

ফারুকের মতো প্রান্তিক শ্রমজীবীদের জীবনে আসলেই কী মে দিবস প্রতিদিনের চেয়ে আলাদা বিশেষ কোনো দিন? দিনটিতে শ্রমিক সংগঠনগুলো মিছিল করে, লাল পতাকার শোভাযাত্রা হয়, গান-নাচ-আবৃত্তি হয়, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বক্তব্য দেন শ্রমিক নেতারা। প্রান্তিক শ্রমিকদের জীবনে এসব আনুষ্ঠানিকতার কী কোনো প্রভাব আছে?

বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের জীবনযাত্রা নিয়ে আলাপ করে সারাবাংলা জানার চেষ্টা করেছেন এসব প্রশ্নের উত্তর।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কয়লা পরিবহন বেড়েছে। লাইটার জাহাজ থেকে কয়লা টানার কাজ করেন মো. মানিক। বাড়ি ময়মনসিংহে। মানিকের সঙ্গেও কথা হয় আনুমাঝির ঘাটে।

বিজ্ঞাপন

মানিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দিবস-টিবস বুঝি না, কাজ করতে হবে, না হলে ভাত জুটবে না। গেল সকালে কাজ করতে আইছি, দিন একটা গেছে, রাতও একটা গেছে, আবার দিন একটা যাইতেছে। দিন-মিন এগুলার হিসাব আমরা করতে পারি না।’


মানিক কাজ করেন আব্দুল জব্বার মাঝির তত্ত্বাবধানে। তার সঙ্গে আরও ১২০ জন শ্রমিক এই ঘাটে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠা-নামার কাজ করে।

আল-আমিনের বাড়ি ভোলায়। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্রমিকরা না খাই মরে, শ্রমিকের কোনো মূল্য নাই। পাঁচ-ছয় মাস ধরে কোনো কাজ নাই। জাহাজ এলেই কাজ পাই।’

গোবিন্দ জলদাসের বাড়ি হাটহাজারী উপজেলায়। একসময় হালদায় মাছ ধরে পেটে ভাত দিতেন। শুধু মাছ ধরে ছয়জনের সদস্যের পরিবারের ভার বহন করা আর সম্ভব হচ্ছে না! গত ছয়মাস ধরে শহরে রিকশা চালাচ্ছেন।

ওয়াসার মোড়ে কথা হয় গোবিন্দ জলদাসের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাপ-দাদুর পেশা ছিল মাছ ধরা। যারা আসল জেলে, তাদের এখন হালদায় ভাত নাই। মা-বাবা আছে, বৌ আছে, এক মেয়ে, এক ছেলে আর আমি। কেমনে চলে সংসার ! চালের দাম কত ? নুনের দাম কত ? বাধ্য হয়ে রিকশা ধরেছি।’

কথায় কথায় গলা ধরে আসে গোবিন্দের, ‘দিন চলে না। ছেলেটার বয়স আড়াই বছর। অসুখ, ডাক্তার দেখাতে পারছি না। পেটে ভাত দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। দিনে ৫০০-৬০০ টাকা ইনকাম করি। নিজেরই ২০০-৩০০ টাকা খরচ হয়ে যায়।’

গোবিন্দের কাছে আর মে দিবস নিয়ে কিছু জানার সুযোগ হয়নি। তার মতো আরেক রিকশাচালক ওয়াহাব মিয়ার সঙ্গে কথা হয় নগরীর হাজারী লেইনের সামনে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মে দিবসের কথা শুনছি। সরকারি বন্ধ। সবার বন্ধ থাকলেও আমাদের বন্ধ নেই। ঘরে বউ-বাচ্চা আছে। একদিন রিকশা না চালালে উপোস থাকতে হয়।’

ওয়াহাবের মতে, মে দিবস বড় মানুষদের। তারা কাজ না করলেও ইনকাম ঠিক থাকে। গরীবের আবার মে দিবস কী !

বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামের কৃষক স্বপন চৌধুরী। তিন পুরুষের পেশা কৃষিকাজ। বয়সের ভারে ন্যূব্জ স্বপনকে এখনও যেতে হয় মাঠে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যে জমিতে ফসল ফলান, সেই জমি এখন আর আগের মতো নেই। জমি হয়ে গেছে একফসলি। কামলার খরচ বেড়েছে, উৎপাদন খরচও অনেক বেশি। কৃষিকাজে আর পোষায় না, পেটে টান পড়ে। ছেলেরা জমি থেকে মুখ ফিরিয়ে চাকরি-বাকরিতে চলে গেছে।

স্বপন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বয়স ৭১। চার বছর বয়সে দাদুর সঙ্গে জমিতে আসা শুরু। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারি না। কামলার বেতন দিনে ৭০০-৮০০ টাকা। এক আড়ি ধান বেচলে একজন কামলার একদিনের খরচ উঠে না। কীভাবে চাষবাস করব?’

তবুও মহান মে দিবস আসে প্রতিবছর। বিশ্বজুড়ে শ্রমিকের জয়গান গাওয়া হয়। বাংলাদেশেও সাড়ম্বরে আয়োজন চলে। মে দিবসের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়, আড়ালে থেকে যায় শ্রমিকের যাপিত জীবনের ইতিহাস।

বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন- মে দিবসের মূল যে অর্জন বা চেতনা সেটি বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ মানুষের কাছেই পৌঁছায়নি। কৃষক, গৃহশ্রমিক, দিনমজুরদের কিংবা যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাজে শ্রম দিচ্ছেন, তারা সব ধরনের শ্রম আইনের বাইরে। তাদের অধিকার মিলছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) চট্টগ্রামের প্রোগ্রাম অফিসার ফজলুল কবির মিন্টু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাদের গবেষণা অনুযায়ী ৬ কোটি ৮০ লাখ শ্রমিক আছে। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত। তারাই মে দিবস সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখে। মে দিবসের মূল অর্জন বা চেতনা সেটি শ্রমিক শ্রেণির বড় অংশের কাছেই পৌঁছায়নি। এসব শ্রমজীবী মানুষকে বঞ্চিত রেখে, আইনের সুরক্ষা থেকে বাইরে রেখে, তাদের মজুরির ব্যাপারটি ঠিকাদার ও মালিকদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়ে মে দিবস পালন করা অর্থহীন।’

‘আমাদের একটি গবেষণায় এসেছে, দেশের নিরাপত্তাকর্মীদের ৬৬ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না। এছাড়া ৮৮ ভাগ মে দিবসে ও ৮৬ ভাগ সরকারি ছুটির দিনে ছুটি পান না। আর মালিকরা কম শ্রমিক দিয়ে অল্প মজুরিতে বেশি কাজ করাতে চান। শ্রমিকদের এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন হতে হবে।’

উল্লেখ্য, ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক মালিকপক্ষকে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণের দাবি জানায়। এ দাবি পূরণের সময় হিসেবে ১৮৮৬ সালের ১ মে নির্ধারণ করেন শ্রমিকেরা। কিন্তু কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের এ দাবি কানে তোলেননি। ফলে ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট নামক স্থানে আন্দোলন গড়ে তোলেন শ্রমিকেরা। সেখানে পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে নিহত হন ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক।

এ ঘটনার দুই বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে পালনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।

পরে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এ আহ্বানের সাড়া হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকেরা মে মাসের ১ তারিখ সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানান। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/এমও

মে দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর