Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘পরকীয়ার কথা জানিয়ে দেওয়ায় মিতুর ওপর ক্ষিপ্ত হন বাবুল’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২ মে ২০২৩ ২১:২৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় অসমাপ্ত সাক্ষ্য শেষ করেছেন মিতু’র বাবা মোশাররফ হোসেন। সাক্ষ্যে তিনি জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের চারদিন আগে ২০১৬ সালের ১ জুন আরও একবার মিতুকে খুনের চেষ্টা হয়েছিল। সেদিনও ছেলে মাহিরকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে ফেরার পথে তাকে হত্যার চেষ্টা হয়। কিন্তু মিতু সেদিন তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে যাওয়ায় তাদের মিশন ব্যর্থ হয়।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২ মে) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জসিম উদ্দিনের আদালতে মিতু হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। গত ৯ এপ্রিল প্রথম সাক্ষী হিসেবে মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

সাক্ষ্যে মোশাররফ হোসেন আরও বলেন, ‘বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে চাকরির সময় আসামি মুসাকে তার অফিসে ডেকে মিতুকে হত্যার সব পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন। মেট্রোপলিটন হাসপাতালের গলিতে মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বাবুল। মুসা বাবুল আক্তারের কাছে অস্ত্র কেনার জন্য টাকা দাবি করে। তখন বাবুল আক্তার মুসাকে নগদ ৭০ হাজার টাকা দেয়। বাকি তিন লাখ টাকা তার বন্ধু প্রেস মালিক সাইফুল ইসলাম তাকে দেবে বলে জানায়।’

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মহানগর পিপি আব্দুর রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভিকটিম মাহমুদা খানম মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাকে জেরা করেছেন। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় আদালত কার্যক্রম মূলতবি করেছেন। আদালত ৮ মে মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।’

বেলা পৌনে ১টার দিকে মোশাররফ হোসেন আদালতে অসমাপ্ত সাক্ষ্য উপস্থাপন শুরু করেন। মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকেল ৩টা ৫৫মিনিট পর্যন্ত চলা জবানবন্দিতে সাক্ষী মোশাররফ বাবুলের পরকীয়ার কারণে তাদের দাম্পত্যজীবনে কলহ, আসামি মুসার সঙ্গে তার স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করা— এসব বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরেন।

মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাবুল আক্তার চট্টগ্রামের বাসায় থাকা অবস্থায় মিতুর ওপর অত্যাচার আরও বৃদ্ধি পায়। ওই সময় তার মা-বাবাও তাদের সঙ্গে বাসায় থাকতেন। মিতু তার মা-বাবাকে বিষয়টি জানালে তারা বাবুলের পক্ষে সমর্থন দিত। চট্টগ্রামের বাসায় থাকার সময়েও বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার বান্ধবীর (আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত) যোগাযোগ ছিল। মিতু জানতে পারলে বাবুল আক্তার তাকে হত্যা করবে এই পরিকল্পনা করতে থাকে। বাবুল আক্তারের বাসায় সাদ্দাম নামে এক কনস্টেবল থাকত। সে মাহিরকে স্কুলের বাসে তুলে দিতে নিয়ে যেত ও আবার নিয়ে আসত। বাসায় জঙ্গি হামলা হতে পারে এ রকম আশঙ্কায় তার বাসার জন্য পৃথক রেজিস্ট্রার রাখতে বাসার দারোয়ানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সুদান যাওয়ার আগে কনস্টেবল সাদ্দামকে বাসায় কম আসতে বলে যায় সে। শুধু মাহিরকে স্কুলে দেওয়া আর নেওয়ার কাজ করতে বলা হয়। বাবুল আক্তার এরপর সুদান মিশনে চলে যান। যাওয়ার আগে সে মুসাকে মিতুকে খুনের ব্যাপারে সবকিছু নির্দেশনা ও বাসার আশেপাশে রেকি করার নির্দেশ দিয়ে যান। বাবুল আক্তার যে এই হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটা যাতে কেউ জানতে না পারে সে নির্দেশও মুসাকে দেওয়া হয়।’

মিতুর বাবা বলেন, ‘পরে মিশনে থাকা অবস্থায় বাবুল আক্তার দুই/তিন বার দেশে আসে। তবে এ সময় সে বাসায় থাকেনি। যাওয়ার মুহূর্তে শেষ দুই/তিন দিন বাসায় থেকেছে। আমরা জানতে পেরেছি, ওই সময় আসামি মুসাকে হত্যার বিষয়ে কয়েকবার নির্দেশনা দিয়েছেন বাবুল আক্তার। বাবুল আক্তার ২০১৫ সালের অক্টোবরে দেশে চলে আসে। আসার পর ফের আসামি মুসার সঙ্গে কথা হয়। মুসা তাকে জানায় তার কাজটা শেষ করতে পারেনি।’

মিতুকে হত্যা করে জঙ্গিদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বাবুলের- এমন কথা জানিয়ে তার শ্বশুর বলেন, ‘২০১৬ সালের এপ্রিলে বাবুল আক্তার চীনে ট্রেনিংয়ে যায়। ওই সময় সে আসামি মুসাকে আবার বলে যায়, আমি চীনে থাকা অবস্থায় মিতুকে হত্যার মিশন শেষ করে দিবে। তবে বাবুল আক্তার চীন থেকে এসে জানতে পারে মুসাকে দেওয়া কাজটি সে শেষ করতে পারেনি। চীনে থাকা অবস্থায় সে মিতুকে জঙ্গিরা বাসা ট্রেস করেছে জানিয়ে বাসা পরিবর্তন করতে বলে।’

‘মিতু তখন তাকে বলে যে, সে আসলে তারপর বাসা দেখবে। মূলত বাসা পরিবর্তনের সময় মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল বাবুল আক্তারের। ২০১৭ সালের মে মাসে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পায় বাবুল আক্তার। ওই সময় পুলিশ সদর দফতর থেকে জঙ্গি হামলা হতে পারে এমন সংবাদ পেয়ে সারাদেশে সবাইকে এলার্ট করে দেওয়া হয়। তখন বাবুল আক্তার ভাবে যে মিতুকে হত্যা করলে জঙ্গি বলে চালিয়ে দিতে পারব। ২০১৬ সালের ১৭ মে ঢাকা পুলিশ সদর দফতরের উদ্দেশে রওনা হয় সে। যাওয়ার আগ মূহূর্তে মুসাকে বলে যায়, আমি ঢাকা থাকা অবস্থায় তুমি মিতুকে হত্যা করবে; যাতে সন্দেহ করতে না পারে কেউ। এই সময় মিতুকে হত্যা করলে জঙ্গিদের দোষী করতে পারব আমি। পরে এই হত্যা মামলার তদন্ত তদারকি করব।’

তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার চট্টগ্রামের বাসায় থাকা অবস্থায় সুদানে চলে যাওয়ার সময় বান্ধবী (আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত) তার মোবাইলে ২৯টি মেসেজ দেয়। সেগুলো মিতু দেখে নিজ হাতে চারটি পাতায় লিখে ফেলে। বাবুল আক্তার চীনে থাকার সময় মিতু বাবুলের রুমে দু’টি বই পায়; যার মধ্যে একটি ‘তালিবান’ ও আরেকটি ‘বেস্ট ক্যাপ সিক্রেট। এই বই দুটি ছিল বান্ধবীর উপহার। বইগুলোতে বাবুল আক্তার ও বান্ধবী কোথায় অবস্থান করেছে এগুলোর স্থান ও তারিখ লেখা আছে। একদিকে বাবুল আক্তারের হ্যান্ড রাইটিং ও অন্যদিকে ওই নারীর হ্যান্ডরাইটিং।’

তিনি আরও বলেন, ‘মিতু আমাকে, আমার স্ত্রী ও তার আপন বোনকে এই বিষটি জানায়। এই বিষয়টি আমরা বাবুল আক্তারের বাবা, বোন ও ভাইকে জানানোর পরও কোনো সুরাহা করতে পারিনি। ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর আমার ছোট মেয়ের বিয়েতে মিতু ও তার সন্তানরা এসেছিল। তবে বাবুল ব্যস্ততা দেখিয়ে আসেনি। আমি এসব ঘটনা চট্টগ্রামের সিনিয়র অফিসারদের জানাই। তারা আমাকে ও আমার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে। তবে পরে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

বাবুলের বান্ধবী মিতুকে কল দিয়ে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে জানিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি মক্কা-মদিনায় হজে গিয়েছিলাম। কোনো একদিন বাদ আসর আমি কাবাঘরের পাশে ছিলাম ৷ ওইসময় বাবুল আক্তার মিশনে ছিল। তখন মিতু আমাকে কল দিয়ে জানায়, মেয়েটি মিতুকে কল দিয়ে হুমকি দিয়েছে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কারণ মিতু তাদের নামে লোকজনের কাছে অপপ্রচার করেছে। আমি ওই সময় মিতুকে তার ফোন রিসিভ করতে নিষেধ করি। বাবুল আক্তার কক্সবাজারে থাকার সময় তাদের পরকীয়ার কথা লোকজনকে মিতু জানানোর কারণে বাবুল তার ওপর আরও ক্ষিপ্ত হয়।’

‘বাবুল আক্তার ২০১৬ সালের ৪ জুন ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে যোগ দেয়। যোগদানের পরদিন বাবুলের ষড়যন্ত্রে মুসাসহ অন্যান্য আসামিদের নিয়ে চট্টগ্রামে জিইসি মোড়ে সকালে সন্তানকে স্কুলের বাসে তুলে দেওয়ার সময় মিতুকে হত্যা করে।’

মিতুর পরিবারকে না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে বাবুল থানায় মামলা করে অভিযোগ করে তার শ্বশুর বলেন, ‘বাবুলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার বন্ধু প্রেস মালিক সাইফুল তার স্টাফকে দিয়ে বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিন লাখ টাকা মুসার সহযোগী মামুনের হাতে পৌঁছে দেয়। মিতু ওই প্রেসের আংশিক মালিক। ওই টাকা মিতুর ব্যবসার লভ্যাংশ। সাইফুল এবং ইরাদ মিতু হত্যার পরে আমাদের ঢাকার মেরাদিয়ার বাসায় গিয়ে বাবুল আক্তারের সঙ্গে দেখা করে। সম্ভবত ঘটনার পরের দিন। পরবর্তী সময়ে বাবুল আক্তার ৬ জুন পাঁচলাইশ থানায় আমাদের না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে মামলা করে।’

‘আসামিদের নাম জানার পরও তাদের নাম উল্লেখ না করে একটি মিথ্যা এজহার দায়ের করে। যা সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে ও আমার মেয়ের বিচার বিলম্বিত করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মামলা চলাকালে আমরা তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রথম আইও কামরুজ্জামানের সাথে চট্টগ্রাম এসে কথা বলার চেষ্টা করি। তবে তিনি কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরকীয়া, মেসেজ ও বইয়ের বিষয়ে কামরুজ্জামানকে জানিয়েছি। তবে তিনি গুরুত্ব দেননি। তদন্তকালীন আমাদের কথা তিনি কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন আমরা জানি না।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘পরবর্তীকালে আইও ছিলেন মাঈনুউদ্দিন। তার সঙ্গে আমাদের কোনো কথা হয়নি। তারপরের আইও সন্তোষ কুমার চাকমা। তার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। মামলা তদন্তকালীন আমাকে, আমার স্ত্রীকে ও আমার ছোট মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি। বাবুল ও আসামিদের ব্যাপারে যেসব তথ্য আমাদের ছিল আমরা উনাকে বলেছি। আমরা নিয়মিত আইও’র সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছি।’

সব তথ্য জেনে নিজেই বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন জানিয়ে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আইও সন্তোষ কুমার চাকমা ২০২১ সালের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে আমাদের জানায়, আমরা তদন্তের শেষ পর্যায়ে। বাবুল আক্তার ও গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ তিনি পেয়েছেন। আইও জানান, আমরা মামলার ফাইনাল রিপোর্ট সাবমিট করব, আপনি এই মামলার বাদী হতে ইচ্ছুক কিনা?’

‘তখন আমি বলি পুলিশ নিজে মামলা না করলে আমি নিজেই আমার মেয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে মামলা করব। তখন আমি আইও’র কাছ থেকে বিস্তারিত ফলাফল জেনে ও নিজে জেনে শুনে ২০২১ সালের ১১ মে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসি এবং সরাসরি সন্তোষ চাকমার কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি। আমার মামলা দাখিলের দিন গায়ত্রী অমর সিং’র মেসেজ, উপহারের বই সন্তোষ কুমার চাকমাকে হস্তান্তর করি।’

মামলার তদন্তকারী অফিসারকে খুনের বিষয় স্বীকার করলেও আদালতে বাবুল তা অস্বীকার করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তারকে ওইদিনই গ্রেফতার করে পুলিশ। এবং পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। আমি তখন পিবিআই অফিসে অবস্থান করছিলাম। রিমান্ডে থাকায় অবস্থায় বাবুল আক্তার মিতুকে হত্যার সব পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, পরকীয়ার জের ও আসামিদের সঙ্গে সম্পর্ক সব স্বীকার করে। বাবুল আক্তার স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য মামলার তদন্তকারী অফিসারকে বললেও আদালতে পাঠানোর পর অস্বীকৃতি জানায়।’

‘আমার দাখিল করা মামলায় আইও কিছু সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। যার মধ্যে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার, কক্সবাজারের পম্পি বড়ুয়া, গায়ত্রীর বাসার দারোয়ান সরোয়ার, বাবুল আক্তারের সাবেক কাজের মেয়ে ফাতেমাসহ আরও অনেকে মিতু হত্যা নিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। আমার মামলা দাখিলের আগে কিছু সাক্ষী সাইফুল, ইরাদসহ আরও অনেকে সাক্ষ্য দেন। মামলা তদন্তকালে আদালত আমার মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে আইওকে মূল মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন।’

তিনি বলেন, ‘এর পরের তদন্তকারী কর্মকর্তা আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমরা আগের ঘটনা তাকে বলি। আমার মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট উনিই দাখিল করেছেন। বাবুল আক্তারসহ সাতজনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছেন।’

যা বললেন বাবুলের আইনজীবী

বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিতুর বাবা গত আট বছরে এই মামলা নিয়ে ১০ রকমের কথা বলেছেন। উনার কথার সঙ্গে কোনো কথার মিল নেই। নানা সময়ে বিভিন্ন তদন্তকারীর কাছে বিভিন্ন ধরনের স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। পিবিআই অফিসে তাকে এনে যে অভিযোগটি নেওয়া হয়েছে সেটা তারা প্রস্তুত করে দিয়েছে।’

‘উনি বাবুল আক্তারকে যেভাবে দায়ী করে কথা বলছেন ঠিক একইভাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বাবুল আক্তারকে নির্দোষ, সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসেবে তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আজ তিনি ভিন্ন কথা বলছেন। ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মামলার আইওকে তার মেয়ের খুনে ভিন্ন কারণ আছে বলে চার পাতার অভিযোগ দেন। তখন এই কথিত পরকীয়ার যে গল্প তার অস্তিত্বই ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাবুল আক্তার একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। সিই হিসেবে তিনি অনেক জায়গায় হস্তক্ষেপ করেছেন। যার কারণে অনেক বড় লোকের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। সেসব বড় লোক, সন্ত্রাসী ও চাকরি জীবনে যাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল উনারা মিলে একটি চক্র গড়ে তুলেছে। ওরাই বাবুল আক্তারের শ্বশুরকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাকে দিয়ে এসব করতে বাধ্য করছেন।’

মোশাররফকে জেরা শুরু

সাক্ষ্য শেষে মোশাররফ হোসেনকে জেরা শুরু করেছেন বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী।

প্রশ্ন- আপনি হত্যামামলাসহ অনেক মামলা তদন্ত করেছেন?
উত্তর– হ্যাঁ।
প্রশ্ন – নিম্ন আদালতে অসংখ্য মামলার সাক্ষী দিয়েছেন?
উত্তর- স্মরণ নেই।
প্রশ্ন- আপনি অভিজ্ঞ হিসেবে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন সে হিসেবে একজন তদন্তকারী কর্মকর্তার কার্যবিধিগুলো ফলো করেছেন?
উত্তর- জ্বি করেছি।
প্রশ্ন- আপনি কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ দেননি?
উত্তর- না, দিইনি।
প্রশ্ন: আপনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, মিডিয়ায় ও টেলিভিশনে মেয়ের ছবিসহ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কিনা?
উত্তর: হ্যাঁ, দিয়েছি।
প্রশ্ন: সে প্রতিবেদনগুলো আপনারা দেখেছেন, পড়েছেন ?
উত্তর: অনেকগুলো দেখেছি।
প্রশ্ন: ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি যুগান্তর পত্রিকায় আপনার সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিল? আপনি পড়েছেন কি না?
উত্তর: স্মরণ নেই।
প্রশ্ন: ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনাদের বাসায় গিয়ে রেকর্ড নিয়েছিল? ওই দিন সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন?
উত্তর: সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গিয়েছিলেন।
প্রশ্ন : ওইদিন আপনি আইওকে যেগুলো বলেছেন পরে সাংবাদিকরা সেগুলোই ছাপিয়েছে, কথাটা সঠিক?
উত্তর: স্মরণে নেই।

আদালতে আবেগঘন পরিবেশ

এদিন বাবুল আক্তারের দুই সন্তান তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। অশ্রুসিক্ত চোখে তাদের কাউকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ও কপালে চুমু খান তিনি। এতদিন পরে বাবাকে পেয়ে সন্তানরাও কান্না করেন। পরে পুলিশ তাদের বের করে দিতে চাইলে বাবুল আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি আমার বাচ্চাদের অনেকদিন দেখিনি। বাচ্চাদের সঙ্গে আমাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হোক।’ তখন আদালত শর্তসাপেক্ষে বাচ্চাদের সঙ্গে তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়।

বাবুল আক্তার বলেন, ‘এখানে ডিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক লোকজন ঢোকে। আমার কানে কানে বলে, যা-ই করো তোমার সাজা নিশ্চিত। উনারা থাকলে সাক্ষীরা নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন না।’

আদালত বলেন, ‘কোর্ট সবার জন্য ওপেন। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কেউ এই মামলার সাক্ষী থাকলে বের হয়ে যান। সরকারি ডিউটির কারণেও কোনো সাক্ষী এখানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।’

ঘটনাক্রম

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সাতজনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ১০ অক্টোবর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া। এতে মুসা ও কালুকে পলাতক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

গত ১৩ মার্চ বাবুল আক্তারসহ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মোশাররফ হোসেনকে প্রথম সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

সারাবাংলা/আইসি/আরডি

বাবুল মিতু হত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর