যে কারণে জাহাঙ্গীরের নৌকা আজমত উল্লার দখলে
২ মে ২০২৩ ২৩:২১
ঢাকা: গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিলের পর তিনি দাবি করে আসছেন যে, মনোয়ন বাতিল হলেও নেত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতাদের আশীর্বাদ তার প্রতি রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন, নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) যেহেতু তাকে দলের মনোনয়ন দেননি তাই তার (জাহাঙ্গীর আলম) প্রতি নেত্রীর আশীর্বাদ নেই। এমনকি আমাদের কোনো নেতারও তার প্রতি আশীর্বাদ নেই।
কেন্দ্রীয় নেতারা আরও বলেন, জাহাঙ্গীর যে বক্তব্য দিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাঁয়তারা করছে, এতে নৌকার বিজয় ঠেকানো যাবে না। আর গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা বলেন, আওয়ামী লীগ আমার পাশে আছে। তাই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চাবি আওয়ামী লীগকে উপহার আমিই দেব।
মঙ্গলবার (২ মে) দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে দলটির সমন্বয় টিমের বৈঠকে এ সব কথা উঠে আসে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের টিম লিডার দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রমের সভাপতিত্বে বৈঠক পরিচালনা করেন সমন্বয়ক ও দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম।
এর আগে, গত ১৫ এপ্রিল দলটির স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় গাজীপুরে নৌকার টিকিট পান আজমত উল্লা খান। ইতোমধ্যে তার পক্ষে নির্বাচনি কার্যক্রম চালাতে ২৮ সদস্যদের কেন্দ্রীয় একটি সমন্বয়ক দল গঠন করা হয়েছে।
এদিকে, মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু রোববার (৩০ এপ্রিল) গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং অফিসার মো. ফরিদুল ইসলাম। খেলাপি ঋণের জামিনদার হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। তবে জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ায় জাহাঙ্গীর অনুসারীদের মধ্যে তাকে নিয়ে আলোচনা চলছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা। তার মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ায় দল মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক পাবেন তিনি।
বৈঠক সূত্র জানায়, বঞ্চিত জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিচ্ছেন যে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের তার প্রতি আশীর্বাদ রয়েছে। এই বক্তব্য নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংশয় তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে গাজীপুরের স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, নেত্রী যেহেতু জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দেয়নি। এর মানে তার উপর নেত্রীর কোনো আশীর্বাদ নাই। আর নেত্রীর যার প্রতি আশীর্বাদ নাই তার প্রতি কেন্দ্রীয় নেতাদেরও আশীর্বাদ থাকার কথা নয়। আর কেউ যদি তাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে সেটাও দলীয় তদন্তে বের করা হবে। আমরা এ বিষয়ে নেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করব। তিনি কী বার্তা দেন, সে বিষয়েও পরে জানানো হবে।
বৈঠকে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা বলেন, ‘কে স্বতন্ত্র প্রার্থী, কে প্রার্থী না সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। আওয়ামী লীগ আমার পাশে আছে, দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চাবি দলকে উপহার দিতে পারব।’ এ সময় বৈঠকে উপস্থিত নেতারা আচরণবিধি যাতে লঙ্ঘন না হয় সেদিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভোটের মাঠে কাজ করার আহ্বান জানান।
বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নির্বাচন দেশবাসীর জন্য, আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়ার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাই আমরা গাজীপুরে সর্বস্তরের জনগণ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার পক্ষের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এই নির্বাচনে জয়লাভ করতে চাই। ভোটের মধ্য দিয়ে আমরা জয়লাভ করতে চাই। সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, আগুন সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে কেউ যেন নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে না পারে তার জন্য কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলছি।’
গাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমন্বয় টিমের প্রধান সমন্বয়ক বলেন, ‘গাজীপুরে আমাদের একটি নির্বাচনি কার্যালয় থাকবে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য থানা ও সেন্টারভিত্তিক কমিটি হবে। এবার স্তরে স্তরে আমরা কমিটিগুলো সাজাব। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ কমিটি হয়ে গেছে। আমরা আশা করি, আগামী ৯ তারিখের আগে নির্বাচনের সব কাজ আমরা শেষ করতে পারব বলে আশা করছি। প্রত্যেকে যেন ভোট দিতে পারে আমরা সে ব্যবস্থা করতে চাই। আশা করি আমাদের নৌকার বিজয় হবে।’
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টিমের উপদেষ্টা ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সিমিন হোসেন রিমি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক জাহানারা বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামসুন নাহার, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, উপদফতর সম্পাদক সায়েম খান, কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত, তারানা হালিম, সানজিদা খানম, আনোয়ার হোসেন, সাহাবুদ্দিন ফরাজী, ইকবাল হোসেন অপু, মোহাম্মদ সাইদ খোকন, রেমন্ড আরেং, নির্মল কুমার চ্যাটার্জি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলসহ দলের সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।
উল্লেখ্য, জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। সেখান থেকে পরে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার নাম আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে। যখন তিনি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়ে ভোটের মাঠে নামেন। সে সময় দলের নির্দেশে ভোট থেকে সরে দাঁড়াননি। পরে কিছুদিন নিখোঁজ থেকে ভোটের ঠিক আগে কাঁদতে কাঁদতে আজমতকে সমর্থন জানান তিনি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে তার নাম থেকে যায়। সেই নির্বাচনে আজমত উল্লা পরাজিত হন। ওই সময় মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিত এম এ মান্নান। পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ২ লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ভিডিও ফুটেজের কথোপকথনের আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। পরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তার দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয়। এরপর মেয়র পদ থেকেও বরখাস্ত হন জাহাঙ্গীর আলম। তবে ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ। সেই ক্ষমা’র শর্ত ভঙ্গ করে দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলে ফের আলোচনায় চলে আসেন জাহাঙ্গীর আলম।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম