জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ, সুফল ‘চসিকের ওপর’
৩ মে ২০২৩ ০৮:৪৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বহুল আলোচিত চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের তিন চতুর্থাংশেরও বেশি সোয়া ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রকল্পের সম্পাদনকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
তবে চট্টগ্রাম শহর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়ার শতভাগ গ্যারান্টি দিতে পারছে না সংস্থাটি। কর্মকর্তারা বলছেন, ড্রেন থেকে নিয়মিত ময়লা-আর্বজনা পরিস্কার করা না হলে বৃষ্টির পানি খালে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই আশপাশের এলাকাগুলো প্লাবিত হবে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত এখন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সুফল নগরবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়ভার অনেকটাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঘাড়ে গিয়ে পড়লো। কারণ, খাল-নালা নিয়মিত পরিস্কারের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষও বলেছেন, সিটি করপোরেশন যদি খাল-নালায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে পারে তবেই এই প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল মিলবে।
মঙ্গলবার (২ মে) দুপুরে নগরীর ওয়াসা মোড়ে ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড কার্যালয়ে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাহ মো. আলী। এসময় ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাসুদুর রহমান এবং সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষও ছিলেন।
২০১৭ সালে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুমোদন পায় সিডিএ। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
প্রকল্পটি সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের সঙ্গে ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল সিডিএ’র সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল থেকে সেনাবাহিনী ড্রেনেজ অবকাঠামো সংস্কার ও পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করে।
প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাহ মো. আলী জানিয়েছেন, প্রকল্পের ভৌত কাজের অগ্রগতি ৭৬.২৫ শতাংশ। নগরীতে মোট ৫৭টি খাল আছে। এর মধ্যে ৩৬টি প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ১৫টি খাল থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ- প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণসহ সার্বিক সংস্কার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। জুনের মধ্যে আরও কমপক্ষে সাতটি খালের কাজ শেষ হবে। বাকিগুলোর কাজ পরবর্তী অর্থবছরের মধ্যে শেষ হতে পারে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
তিনি জানান, ১৭৬ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়ালের মধ্যে ১১৮ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ৪৫টি ব্রিজ ও ৬টি কালভার্টের সবগুলোর নির্মাণ শেষ হয়েছে। সড়কের পার্শ্ববর্তী ১৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেন সংস্কারের পাশাপাশি ১০.৭৭ কিলোমিটার নতুন ড্রেন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
খালের মুখে ৫টি রেগুলেটর নির্মাণের কাজও একেবারে শেষেরপথে। ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপের মধ্যে ১৩টি স্থাপন করা হয়েছে। খালপাড়ের রাস্তা ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটারের মধ্যে ১৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং ৫০ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ৫.৫০ মিটারের কাজ শেষ হয়েছে।
তবে সিডিএ’র ভূমি অধিগ্রহণের কাজ এখনও শুরুই হয়নি। এক্ষেত্রে অর্থবরাদ্দে কোনো সংকট আছে কি না জানতে চাইলে লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাহ মো.আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাজের ক্ষেত্রে অর্থের কোনো সংকট নেই। এখন অর্থের প্রয়োজন ভূমি অধিগ্রহণের জন্য। সেটা সিডিএ করবে।’
তিনি জানান, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ হাজার ১৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা ইতোমধ্যে বরাদ্দ পেয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
প্রকল্প সম্পাদনকারী সংস্থার তথ্যমতে, নগরীতে জলাবদ্ধতা দূর করতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, খাল ও ড্রেনের ওপর মোট ৫৯টি পয়েন্টে ব্রিজ-কালভার্টের নিচ দিয়ে যাওয়া সেবা সংস্থার পাইপলাইনগুলো। সেগুলোতে গাছের গুঁড়ি, প্লাস্টিক, কম্বল-কাঁথাসহ বিভিন্ন বর্জ্য আটকে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। নিয়মিত পরিস্কার না করায় অনেক খাল-নালা ভরাট হয়ে সেখানে পেঁপে ও শাকসবজির চাষ হতো।
এছাড়া নিচু ব্রিজ-কালভার্ট ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে নগরীর ১৮ শতাংশ এলাকায় দিনে অন্তঃত দুইবার জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়।
সেনাবাহিনী খালের মুখে ৫টি রেগুলেটর নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করায় জলাবদ্ধতার আংশিক উন্নতি হয়েছে দাবি করে শাহ আলী বলেন, ‘গত অমাবস্যায় আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকা, হালিশহরে জোয়ারের পানি উঠেনি। মহেশখালে রেগুলেটর নির্মাণের কারণে সেটা সম্ভব হয়েছে। আগামী অমাবস্যা-পূর্ণিমায় সেটার প্রমাণ আপনারা চাইলে নিতে পারেন। মহেশখাল ছাড়াও ফিরিঙ্গিবাজার, টেকপাড়া, মরিয়ম বিবি ও কলাবাগিচা খালে রেগুলেটর স্থাপন করা হয়েছে।’
এছাড়া সিডিএ আলাদাভাবে ১২টি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৩টি রেগুলেটর নির্মাণের কাজ করছে বলে তিনি জানান।
শাহ আলী বলেন, ‘আমরা ৩৬টি খাল সংস্কার করছি। প্রকল্পের বাইরে আরও ২১টি খাল আছে। সেগুলোরও পানিপ্রবাহ সচল রাখতে হবে। নগরীতে মোট ১৬০০ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে আমরা ৩২০ কিলোমিটারের আবর্জনা অপসারণ করছি। বাকি ১৩০০ কিলোমিটার যদি পুরোপুরি পরিস্কার করা না হয়, তাহলে জলাবদ্ধতা পুরোপুরি অপসারণ করা সম্ভব নয়। আর এর দায়দায়িত্বও তখন প্রকল্পের ওপর বর্তাবে না।’
৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ব্রিগেডের পক্ষ থেকে পার্বত্য এলাকাসহ চট্টগ্রামে আরও চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জলাবদ্ধতা প্রকল্প, এটা অনেক জটিল একটা প্রকল্প। বলা হচ্ছে যে, প্রকল্পের কাজে দেরি হচ্ছে। আমরা কাজ করতে পারি মাত্র ছয় মাস। ১২ মাস আমরা কাজ করতে পারি না। কারণ, কাজ করতে গেলে খালের মধ্যে বাঁধ দিতে হয়। তখন পানি জমে মানুষের ভোগান্তি হয়।’
‘দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বেদখল হওয়া ভূমি। এ ধরনের ভূমিতে কাজের গতি স্লো হওয়া স্বাভাবিক। অনেক ভূমিতে কবরস্থান-শ্মশান আছে। সেগুলো মানুষের অনুভূতির জায়গা। আমরা তো মানুষকে কষ্ট দিয়ে কাজ করতে পারি না। ইউটিলিটি সার্ভিসের পাইপলাইন আছে। একটা পাইপলাইন সরাতে সংস্থার অফিসে ঘোরাঘুরি করতেই ছয় মাস লাগে। অথচ দেড় মাসে আমাদের ব্রিজ-কালভার্ট হয়ে যায়।’
যতটুকু কাজ হয়েছে তাকে কিছুটা সুফল এবারের বর্ষার নগরবাসী পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘যেভাবে আমরা কাজ করছি, কাজ যা হয়েছে ইনশল্লাহ সুফল আসবে। আশা করছি, আগের মতো পানি হবে না। জলাবদ্ধতা আগের মতো হবে না। পুরোপুরি সুফল হয়তো পাব না, তবে ভোগান্তি আস্তে আস্তে কমে আসবে।’
৩৬ খালের কাজ শেষ হলে সেগুলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়া হবে জানিয়ে ব্রিগেড অধিনায়ক বলেন, ‘আমরা কাজ শেষ করে চলে যাবে। কিন্তু প্রকল্পের কাজের তো স্থায়ী থাকবে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এখন খালগুলো, ছোট ছোট ড্রেনগুলো যদি পরিস্কার রাখা না হয়, সেখানে যদি ময়লা-আবর্জনা ফেলা না হয় তাহলে তো সুফল আসবে না। সুফল পেতে হলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজটা নিয়মিত করতে হবে।’
সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘করোনার কারণে দুই বছর কাজ হয়নি। মাত্র তিন বছরে সেনাবাহিনী যে কাজ করেছে, এটা যদি আমরা অন্য কোনো ঠিকাদারকে দিয়ে করাতাম, তাহলে ১৩ বছর সময় লাগতো। আশা করছি, এবার বর্ষাকালে পানি উঠবে না। আগ্রাবাদ-হালিশহরে জোয়ারের পানি যেটা আসত, সেটা এবার হবে না।’
দায়িত্ব এখন সিটি করপোরেশনের- মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে দোষারোপ করছি না। তবে সিটি করপোরেশন বলেছিল- খালে বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। আমরা বাঁধ সরিয়ে নিয়েছি। কিন্তু বাঁধ সরিয়ে নিলে তো হবে না, পানি তো ড্রেন দিয়ে খালে আসতে হবে। ড্রেন নিয়মিত পরিস্কার না করলে সেখানে যদি ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে, তাহলে পানি খালে যাবে কিভাবে ? সেজন্য ড্রেন নিয়মিত পরিস্কার রাখতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে তারা যেন ময়লা-আবর্জনা খালে-নালায় সরাসরি না ফেলে। সিটি করপোরেশনের আইনে জরিমানার বিধান আছে। সেটা প্রয়োগ করে তারা খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে পারে।’
উল্লেখ্য, একবছর আগে ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল বর্ষায় জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ লাঘব নিয়ে সমন্বয় সভায় বসেছিল সিটি করপোরেশন ও সিডিএ। সেই সভায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় সংস্কার হওয়া খাল-নালা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নেওয়ার কথা আলোচনায় এসেছিল।
জবাবে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য ১০০ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন। অন্যথায় সিটি করপোরেশনের পক্ষে এই বোঝা ঘাড়ে নেওয়া সম্ভব হবে না বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/এমও