Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রফিটের লভ্যাংশ চেয়ে গ্রামীণফোনকে কর্মীদের চিঠি

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩ মে ২০২৩ ১১:৪৪

গ্রামীণফোনের প্রধান কার্যালয় (ছবি: গুগল ম্যাপ)

ঢাকা: পাওনা টাকা ফেরত চেয়ে গ্রামীণফোনকে চিঠি দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। ২০১৫ সালে প্রাপ্ত ২০১০-১২ সালের ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডের (ডব্লিউপিপিএফ) মূল টাকার উপর বিলম্ব জরিমানা বা সুদের পাওনা টাকা চেয়ে ইতোমধ্যে ৫০০ কর্মী চিঠি পাঠিয়েছেন। ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালের প্রায় চার হাজার কর্মীর এভাবেই গ্রামীণফোনের কাছে চিঠি পাঠানোর কথা রয়েছে।

তাদের দাবি, মামলা প্রত্যাহার করায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী গ্রামীণফোনের কাছে কর্মীদের পাওনা রয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃত হিসাবে এই অংক আরও বেশি হতে পারে। তবে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছে।

জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের সাবেক সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার আ ফ মুস্তাছিম বিল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১০, ১১ ও ১২ সালে যারা গ্রামীণফোনে চাকরিতে ছিল নিয়ম অনুযায়ী তাদের কোম্পানির প্রফিটের ৫ শতাংশ দেওয়ার কথা। কিন্তু গ্রমীণফোন ওই আইনের বিরুদ্ধে রিট করে। পরে সরকার শ্রম আইন পরিবর্তন করে সেখানে টেলিকম খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে। তখন গ্রামীণফোন জানায়, তারা প্রফিট শেয়ার করবে। সে অনুযায়ী তারা প্রফিটের টাকা দেয়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী ওই প্রফিটের ওপর যে লভ্যাংশ আসে সেটাও তাদের দেওয়ার কথা। দীর্ঘদিন ধরে তারা সেই টাকা দিচ্ছে না। সম্প্রতি আমরা ওই মামলায় অ্যাডেড পার্টি হই। পরে গ্রামীণফোন তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। তাই তাদের লভ্যাংশের টাকাও দিতে হবে। এখন আমরা প্রাপ্য টাকা পেতে গ্রামীণফোনকে চিঠি দেওয়া শুরু করেছি।’

গ্রামীণফোনের সাবেক কর্মী ও জেনারেল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (জিইইউজিপি) সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইফতিয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কর্মীর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ জন চিঠি পাঠিয়েছেন। পাওনা টাকা চেয়ে বাকিরাও গ্রামীণফোনকে দ্রুত চিঠি দেবে।’

গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, “আমি, …. গ্রামীণফোন আইডি (…), ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত সময়কালে আপনার কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেডের (…) ডিভিশনের অধীন (…..) ডিপার্টমেন্টে একজন স্থায়ী শ্রমিক/কর্মচারী হিসাবে (…) পদে নিযুক্ত ছিলাম। তৎকালে, ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জারি করা এবং একই সালের ৭ অক্টোবর সরকারি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকাশিত একটি SRO No. 336- Ain/2010 এর দ্বারা বাংলাদেশের সব মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলিকে বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর ধারা ২৩৩ (১)(চ) এর অধীন Industrial Undertaking এর আওতাভূক্ত করা হয়। ফলে ২০১০ সাল থেকেই জিপিতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের Workers Profit Participation Fund (WPPF) এবং Workers Welfare Fund (WWF) প্রাপ্য হয় কিন্তু আপনি, গ্রামীণফোন লিমিটেড Industrial Undertaking সংক্রান্ত উক্ত সরকারি গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে ৩৪৬৬/২০১১ নং রিট পিটিশন দায়ের করিলে, আদালত বিগত ২ মে, ২০১১ তারিখে একটি Rule Issue করে উক্ত গেজেটের কার্যকারীতা শুধুমাত্র গ্রামীণফোনের ওপর স্থগিত করেন এবং সেই সুযোগে আপনি আপনার শ্রমিক কর্মচারীদের প্রাপ্য WPPF এবং WWE দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।”

চিঠিতে আরও বলা হয়, পরবর্তীতে একজন কর্মী মোহাম্মদ মইনুল কাদের উক্ত ৩৪৬৬/২০১১ নং রিট মোকদ্দমায় ৩ নং রেসপনডেন্ট হিসেবে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করিলে ১৫ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে মূল মোকদ্দমাটির Rule শুনানি শেষে উচ্চ আদালত পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেন। যে কারণে ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই, গ্রামীণফোন লিমিটেড ২০১০-২০১২ সালের WPPE এবং WWF এর সুদ ছাড়া মূল পাওনা GP WPPF & WWF Board of Trustees কে দেওয়ার পর ২০১৫ সালে শ্রমিক-কর্মচারীগণ সেই পাওনা প্রাপ্ত হন।

কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও ২০১০-২০১২ সালের WPPF & WWF এর সুদ বিলম্ব জরিমানার বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ায় পরবর্তীতে আমাদের সহকর্মী আহমদ মঞ্জুরুদ্দৌলা, মীর ইফতিয়ার হোসেন, আ ফ ম মোস্তাছিম বিল্লাহ এবং মো. জসীম উদ্দিন ৩৪৬৬/২০১১ নং রিট মোকদ্দমায় ৫-৮ নং রেসপনডেন্ট হিসেবে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে উচ্চ আদালত বিগত ১৪ নভেম্বর, ২০১২ তারিখে উক্ত পক্ষভুক্ত করেন। এরপর গ্রামীনফোনের দায়ের করা রিট মোকদ্দমাটি ৬ মার্চ, ২০২৩ সালে প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে ৭ অক্টোবর, ২০১০ সালের প্রকাশিত Industrial Undertaking সংক্রান্ত সরকারি গেজেট মেনে নেওয়া হয়েছে, বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর সংশ্লিষ্ট ধারা ও উপধারা অনুযায়ী ২০১০-২০১২ সালের WPPF এবং WWF এর মূল টাকা বিলম্বে দেওয়ায় যে সুদ/বিলম্ব জরিমানা প্রাপ্য হয়, হিসাব নিকাশ করে তা আবেদন প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে আমাকে (সংশ্লিষ্ট চিঠির প্রেরক) বুঝাইয়া দিতে, কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহনে আপনার মর্জি হয়।’

প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে গ্রামীণফোনের সাবেক কর্মী ও জেনারেল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (জিইইউজিপি) সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইফতিয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গ্রামীণফোন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন গঠন করি ২০১২ সালে। তখন একটি গণছাঁটাই হওয়ার পর ইউনিয়নের কার্যক্রম শুরু হয়। ইউনিয়ন গঠনের পর ডোনেশন ও মেম্বার কালেকশন শুরু করি। কিন্তু গ্রামীণফোন তিন বছর পর ইউনিয়নের নেতাদের প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ নেতাও বিক্রি হয়ে যায়। ইউনিয়নের কাজ হচ্ছে, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু ওই সময়ের নেতারা গ্রামীণফোনের স্বার্থরক্ষার কাজে নেমে যায়। তারা ইউনিয়নের কোনো কাজ না করে গ্রামীণফোনকে সাহায্য করছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের বেশিরভাগ কর্মী টেকনোলজি বেইজড। আমরা নেটওয়ার্কের কোয়ালিটি মেইনটেইন করতাম। তারা টার্গেট করে ২০১৭ সালের দিকে একটা প্রজেক্টের নাম দেয় ‘কমন ডেলিভারি সেন্টার’। ৬৫৩ জন কর্মীর চাকরি খাওয়ার জন্য একটি প্রজেক্ট তৈরি করে। তার মধ্যে আমার নামও ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই ৬৫৩ জনকে ছাঁটাই করতে পারলে ইউনিয়নটা থাকবে না। আর ইউনিয়ন না থাকলে গ্রামীণফোনেরও ঝামেলা থাকবে না। তখন আমরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করি। ছয় মাস আন্দোলনের পর তারা প্রজেক্ট থেকে বের হয়ে আসে। এর পর তিন মাস স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ২০১৭ সালে ইউনিয়ন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর পর ২০১৯ সালের জুলাইয়ে আমাদের টার্মিনেট করে।’

মীর ইফতিয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘এর পর আমরা মামলা করি। ওই মামলা এখনও চলমান। আশা করছি, মামলায় জিতব। আমাদের হারার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ৩৩ ধারার মামলায় গ্রামীণফোন কখনও জিততেই পারে না। আমি সাংগঠনিক সম্পাদক ও আমার ইউনিয়ন আদালতে পেন্ডিং। নিয়ম অনুযায়ী, আদালতে ট্রেড ইউনিয়ন পেন্ডিং থাকা অবস্থায় আমার চাকরি খাওয়া তো দূরের কথা ট্রান্সফার করারও রাইট রাখে না কোম্পানি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের গেজেট অনুযায়ী ২০১০, ১১, ১২ সালের প্রফিটের টাকা পাওনা ছিল। কিন্তু তারা রিট করে টাকাটা আটকে রাখে। সরকার গেজেট পাস করে, তারা গিয়ে রিট করে। সরকার গেজেট পাস করলে গ্রামীণফোন জানায়, তারা এর আওতাভুক্ত না। এক বছর যাওয়ার পর সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী গ্রামীণফোন কমিউনিকেশন সেক্টরের আওতায় পড়ে। তখন আর গ্রামীণফোনের কিছু করা থাকে না। তবে তারা মামলা উঠায়নি। যে এডেড পার্টি ছিল তাদের কিনে ফেলে। ফলে মামলা চালানোর কেউ ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময় গ্রামীণফোন একটা আবেদন করে বলে, ২০১০, ১১ও ১২ সালের প্রফিটের আসল টাকাটা ডিসবার্স করার অনুমোদন দেওয়া হোক। আর ওই প্রফিটের ওপর ইন্টারেস্টের টাকাটা মওকুফ করা হোক। রিটের বিপরীতে তারাই এই আবেদন করে। কোর্ট তখন গ্রামীণফোনকে জানায়, তুমি আসল টাকাটা দিয়ে আস। ইন্টারেস্টের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। ২০১৪ সালে আমাদের প্রফিটের টাকাটা দিল, আমরা নিয়ে নিলাম। সেই টাকার চেক দেওয়ার সময় একটা আন্ডারটেক রাখল। আন্ডারটেকটা এমন যে আপনাকে পড়তে দিল না। বলল, আপনি সাইন করুন, চেক নিয়ে যান।’

মীর ইফতিয়ার বলেন, ‘ট্রাই পার্টি এগ্রিমেন্ট থাকলে তিন জনের কাছেই এগ্রিমেন্টের কপি থাকে। কিন্তু আমাদের কোনো কপি সরবরাহ করা হয়নি। এটাকে ল’তে বলে বয়েড। আপনি সাইন নিলেও আইনে টিকবে না। আমরা যদি ক্লেইম করি তাহলে জিতব। এর পর সম্প্রতি আমরা অনুধাবন করি, এই মামলা আমাদের চালানো দরকার। পরে অ্যাডেড পার্টি হওয়ার জন্য আমরা চার জন আবেদন করি। তখন কোর্ট আমাদের অ্যাড করে রায় দেয়। আমরা মামলার শুনানিতে চলে গেছি।’

তিনি বলেন, ‘কোর্ট মৌখিকভাবে জানিয়েছে, যেহেতু গ্রামীণফোন এত বড় কোম্পানি তারা শ্রমিকদের টাকা দিয়ে দেবে। তবে এটা অর্ডারে আসেনি। গ্রামীণফোন যে রিট উইথ-ড্র করেছে, তার মানে তারা সরকারের গেজেট মেনে নিয়েছে। সেহেতু প্রফিটের ওপর লাভের টাকাটা আমরা পাব। আমাদের প্রায় চার হাজার শ্রমিক। ওদের একটা হিসাবে ইন্টারেস্টের টাকা ২ বিলিয়ন ডলারের মতো, মানে ২১ হাজার কোটি টাকা। আমাদের হিসাবে এই টাকা আরও বেশি হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যতদূর শোনা, গ্রামীণফোনকে ইন্ডিয়ান কোম্পানি জিও’র কাছে বিক্রির কথা চলছে। তারা অনেক দূর এগিয়েছে। অ্যাসেট ভ্যালুও করে ফেলেছে। এই তথ্যটা শোনা যাচ্ছে যে, সেখানে প্রফিটের ওপর লাভ নিয়ে দুই বিলিয়ন ডলারের একটা এসেসমেন্ট এসেছে। এই অর্থটা ২০১০, ১১ ও ১২ সালে যারা পারমানেন্ট কর্মী ছিল তাদের প্রাপ্য।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/এমও/পিটিএম

গ্রামীণফোন চাকরিচ্যুত পাওনা টাকা সাবেক কর্মীদের চিঠি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর