স্বামী ফোনে জানান ‘রিমা অসুস্থ’ বাবা মর্গে পেলেন মেয়ের লাশ
৬ মে ২০২৩ ২১:৫৯
ঢাকা: গত ৭ এপ্রিল রাজধানীর শেরে বাংলানগর সংসদ সচিবালয় কমপ্লেক্সের ১১০১/এ-৩ নম্বর ফ্ল্যাটে গৃহবধূ ইসরাত জাহান রিমা’র (১৯) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে পুলিশ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে গিয়ে মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট করে।
রিমার স্বামী সাদ্দাম হোসেনের দাবি— ঝগড়ার একপর্যায়ে রিমা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। তবে রিমার বাবার অভিযোগ, রিমা আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর ফ্যানে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। যুক্তি দেখিয়ে রিমার বাবা মান্নান হাওলাদার বলেন, ‘পুলিশকে না জানিয়েই তারা মরদেহ নিয়ে মর্গে গেছেন। আমাদের খবর দেওয়া হয়েছে রিমা অসুস্থ হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আছে আপনারা চলে আসেন। কিন্তু ঢাকায় থাকা রিমার আত্মীয় স্বজনরা হাসপাতালে গিয়ে দেখেন রিমাকে মর্গে নেওয়া হয়েছে। রিমা আত্মহত্যা করেছে।’
পরিবারের অভিযোগ, রিমাকে মেরে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা হিসেবে চালানো হয়েছে। পুলিশের অসহযোগিতাও পেয়েছেন পরিবার সদস্যরা। সবশেষ থানা পুলিশ মামলা নিলেও আসামি গ্রেফতারে গড়িমসি করা হয়। একপর্যায়ে পুলিশ আসামি গ্রেফতারে গিয়ে জানতে পারে, আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের জামিন পেয়েছেন।
শনিবার (৬ মে) রিমার বাবা মান্নান হাওলাদার সারাবাংলাকে বলেন, ২০২২ সালের ২ এপ্রিল পারিবারিকভাবে রিমার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের কাবিন হয়। এরপর বলা হয়েছিল রিমা অন্তত এইচএসসি পাস করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হবে। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে সাদ্দাম হোসেন জানায়, এপার্টমেন্টে নতুন বাসা পেয়েছি। সেখানে একা কী করে থাকি? তাই রিমাও এসে বেড়িয়ে যাক। যেহেতু বিয়ে হয়েছে তাই মেয়েকে জামাইয়ের বাড়িতে পাঠাই। এরপর রিমাকে আর যেতে দেননি সাদ্দাম হোসেন। রিমাও থেকে যায় আগারগাঁওয়ের ওই বাসায়।
রিমা এবার (৩০ মে) পটুয়াখালী আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। মৃত্যুর আগের দিন রিমা হাসপাতালে গিয়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট করেছিল। মৃত্যুর দিন সকালে মাকে বলেছিল সে কথা। মা হতো সে। কিন্তু তার আগেই পৃথিবী ছাড়তে হলো তাকে।
রিমার আত্মীয়-স্বজন ও তার বাবার অভিযোগ অনুযায়ী সারাবাংলার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়।
১০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি
রিমার মৃত্যুর ৬/৭ দিন আগে সাদ্দাম হোসেনের বোন আসমা আকতার (রিমার ননদ) রিমার বাবাকে ফোন করেন। ননদ জানান, আপনারা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আমার ভাইকে আপনারা কী দিয়েছেন? যা দিয়েছেন, ভালো কথা। এখন আমার ভাইকে ১০ লাখ টাকা দেন। জবাবে রিমার বাবা বলেছিল, আমার যা সামর্থ্য ছিল তা দিয়েছি। আরও যা দেওয়া লাগে তা দেব। কিন্তু ১০ লাখ টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই আমার। সামর্থ্য থাকলে ফ্ল্যাটও কিনে দিতাম। এরপর ওইদিনই রিমার শাশুড়ি তার মাকে ফোন করে বলে, আপনার মেয়ে ভালো না। মেয়েকে ভালো হতে বলেন। কথায় কথায় ঝগড়া করে। সংসারে অশান্তি শুরু করেছে আপনার মেয়ে।
রিমার বাবা বলেন, মেয়ে স্বামীর বাসায় যাওয়ার পর দুটো খাট, একটি আলমারি, একটি শোকেস, একটি ড্রেসিং টেবিল, একটি ডাইনিং টেবিল, একটি ফ্রিজ, ফ্যান, কিচেনের আসবাবপত্রসহ সংসারের নানানপ্রকার জিনিসপত্র কিনে দিয়েছি। এর বাইরে মেয়েকে ৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার দিয়েছি। একটিই মেয়ে তাই সাধ্যমত দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবুও মেয়েটা শান্তি পেল না। শেষে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হলো।
রিমার বাবা জানান, মেয়ের বাবার বাড়ি বরগুনার আমতলী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। আর ছেলের বাড়ি আমতলী উপজেলার কৃঞ্চনগর কুকুয়া গ্রামে। ছেলের বাবা নেই। অভাব অনটনের সংসারে লেখাপড়া করে বড় হয়েছে ছেলে। আমরা বিয়ে দিতে চাইনি। তারপরও মেয়ের মামাকে দিয়ে বারবার প্রস্তাব দেওয়ায় বিয়েতে রাজি হয় পরিবার। কিন্তু ওই পরিবারে মা এবং বোন যে এত খবরদারি করবে তা জানা ছিল না। সাদ্দাম ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের পরিবহন শাখায় কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরিতে যোগদান করেন। শর্ত হচ্ছে আগামী পাঁচ বছর পর পদটি স্থায়ী হবে।
‘আমারে নিয়ে যাও, না হলে মেরে ফেলবে’
ঘটনার দিন সকাল ৭টার দিকে প্রথম বাবার মোবাইলে কল করে রিমা। না পেয়ে ভাইয়ের মোবাইলে কল করে সকাল ৯টা ৪১ মিনিটে। এ সময় ১ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড মা ও ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। ওই সময় রিমা মাকে সে অন্তঃস্বত্ত্বা হয়েছে সেটি জানায়। এরপর চুপ করে থাকে। কী যেন বলতে চায়। নানান কথা শেষে রিমা বলে, তোমরা আমাকে এই বাসা থেকে নিয়ে যাও। না হলে এরা আমাকে মেরে ফেলবে। এরা ভালো না।
রিমার সংসারে মা-বোন দুলাভাইয়ের কর্তৃত্ব
রিমার সঙ্গে তার মায়ের কথা হলেই রিমা প্রায়ই বলত, সংসারে সাদ্দামের মা, বোন ও দুলাভাই যা বলে তাই হয়। প্রতিটি ব্যাপারেই বোন ও দুলাভাই এসে নাক গলায়। তারা কেউই ন্যায়-অন্যায় বোঝে না। তারা শুধু একদিকে দেখে। আমাকে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। রান্না করলেও নিজের ইচ্ছামতো কিছু খেতে পারি না। ওনারা খাওয়ার পর আমাকে খেতে হয়। সাদ্দামও স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতিও যত্নবান নয়।
বাবার অভিযোগ, রিমাকে হত্যা করা হয়েছে
মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে তার স্বপক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন বাবা। তিনি বলেন, ৯ টা ৪১ মিনিটে কথা হয়েছে। এরপর রিমাকে ১০টা ১৫ মিনিট, ১০টা ১৬ মিনিট, ১০টা ১৭ মিনিট ও সবশেষ ১০টা ৩৮ মিনিটে কল করা হয়েছে। কিন্তু রিমা কল ধরেনি। এরপর ১০ টা ৪৫ মিনিটে সাদ্দাম কল রিসিভ করেন। এসময় সাদ্দাম রিমার বাবাকে বলেন, আপনার মেয়ে ভালো না। ভালো হতে পারল না। আপনার মেয়েকে আপনি এসে নিয়ে যান। তখন বাবা সাদ্দামকে বলে, ঠিক আছে আমি ঢাকায় আসতেছি। তোমার কাছে মেয়েটাকে জিম্মা রাখলাম। আমি এসে মেয়েকে নিয়ে যাব।
তখন সাদ্দাম জানায়, আপনার মেয়ে অসুস্থ। তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, আপনারা আসেন।
এরপর রিমার বাবা সাদ্দামের দুলাভাইকে ফোন করে বলেন, বাবা তুমি একটু ওই বাসায় যাও। পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। তখন দুলাভাই জানায়, আপনার মেয়ে ভালো না। শুধু শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে। আমি যেতে পারব না। আপনি চলে আসেন ঢাকায়। তখন রিমার বাবা ঢাকায় থাকা স্বজন মিজানুর রহমান মামুন ও বোনকে ওই বাসায় যেতে বলেন। আর রিমার বাবা বরগুনা থেকে ঢাকার দিকে রওনা হন।
পুলিশে খবর না দিয়েই দরজা ভাঙার অভিযোগ
ঢাকায় থাকা রিমার আত্মীয় স্বজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে রিমাকে না পেয়ে মর্গে খোঁজ নেন। মর্গে রিমার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পাশে থাকা স্বামী সাদ্দাম ও তার দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, রিমা ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তখন আপনারা কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে তারা জানিয়েছেন, আমাকে বারান্দায় আটকে রেখেছিল রিমা। সেই বারান্দা থেকে ঘরে দেখার মতো জানালা ছিল না। আর মা ও বোন অন্য কক্ষে ছিলেন। এরপর টের পেয়ে দরজার তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে বটি দিয়ে ওড়না কেটে রিমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা রিমাকে মৃত ঘোষণা করে।
রিমার বাবার অভিযোগ, কেউ আত্মহত্যা করলে ঘটনাস্থলের আলামত নষ্ট হয়ে যাবে এ জন্য মরদেহে হাত দেওয়া নিষেধ। কিন্তু পুলিশকে খবর না দিয়েই তারা মরদেহ নিয়ে ছুটল!
রিমার বাবার অভিযোগ, আমরা জানতে চেয়েছিলাম, কপালে কীসের কাটা দাগ আর দরজার তালা ভাঙলেন কী করে? তখন তারা বলেছে, তালাভাঙা মিস্ত্রি এনে ভাঙা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আনতে পারল আর পুলিশকে খবর দিতে পারল না। আর ওড়না কাটতে গিয়ে বটির আঘাত লেগেছে কপালে বলে জানায়। রিমাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এরপর ভিডিও করে তারপর মরদেহ নামানো হয়েছে। এ জন্য পুলিশকে খবর দেয়নি তারা।
এক ঘণ্টার মধ্যেই রিমার মৃত্যু
ঘটনার দিন সকাল ৯টা ৪১ মিনিটে রিমা তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আর ১০টা ৪৫ মিনিটে জানতে পারেন রিমাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তার মানে প্রায় ১ ঘণ্টার মধ্যেই রিমা মারা গেলেন।
রিমা ফ্যানে ঝুলছিল, বারান্দায় স্বামী?
স্বামী সাদ্দামের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি বারান্দায় ছিলেন। ভেতর থেকে দরজা আটকানো ছিল। কিন্তু এ সময়টায় তিনি কেন চিৎকার করেননি। রিমার বাবার অভিযোগ, তাদের করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বারান্দার পাশেই রুমের জানালা। সেখানে গ্রিল দেওয়া এবং গ্লাসে ঘেরা। পর্দাও ছিল। অথচ সাদ্দাম রিমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না।
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, বোন দরজা খুলে দিলে সাদ্দাম কক্ষে ঢুকেই রিমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। মা চিৎকার শুরু করলেন। পাশে থেকে কে ভিডিও করছিলেন তা এবং দরজা ভাঙা হয়েছে কিনা তাও দেখা যায়নি ভিডিওতে। রিমা ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো অবস্থায় থাকলেও শরীরের বেশির ভাগ অংশই বিছানায়। ফ্যানের এক পাখাতে ওড়না বাঁধা ছিল যেটি হেলে এসেছে। বিছানায় টুল বা অন্য কোনো উঁচু বস্তুও দেখা যায়নি। বাবার অভিযোগ, কেউ আত্মহত্যা করলে এক ঘণ্টার মধ্যে মরদেহ বিছানায় নুয়ে পড়ার কথা নয়।
জন্মদিনে স্বামীকে দেওয়া চিঠি ‘সুইসাইড’ নোট হিসেবে উপস্থাপন
ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে স্বামী সাদ্দাম হোসেনের জন্মদিনে রিমাকে একটি চিঠি লিখেছিল। ওই চিঠিতে ভালোবাসার নানা কথা লিখেছিল। তাকে যেন ছেড়ে না যায় স্বামী সে কথাও লিখেছিল। সবশেষে ম্যানি ম্যানি রিটার্নস অব দ্য ডে, হেপি বার্থডে টু ইউ জান পাখি। রিমার লেখা সেই চিঠিটি তারা কৌশলে বিছানায় রেখেছিল। মর্গে সুরতহাল রিপোর্ট শেষ করে ওই বাসায় গেলে পুলিশ রিমার লেখা সেই নোটটি পায়।
রিমার বাবার অভিযোগ, পুলিশ ওই বাসায় আমাদের কাউকে নিয়ে যাননি। অনেক অনুরোধ করার পর পুলিশ রিমার ফুফুকে সঙ্গে নিয়ে গেলেও বাসার ভেতরে ফুফুকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ফুফুকে বাসার নিচে রেখেই পুলিশ ওই বাসায় যায়। হত্যার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এ ঘটনায় পুলিশ ওই দিন কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও থানায় নেয়নি।
মামলা নিতে গড়িমসি, অবশেষে আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলা
রিমার বাবার অভিযোগ, ঘটনার পর পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি শুরু করে। পুলিশ বলে এটি আত্মহত্যা। তাই অপমৃত্যুর মামলা হবে। কোনোভাবেই মামলা নিচ্ছিল না। পরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে ৭ এপ্রিল রাত দুইটার দিকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা নেয় শেরে বাংলানগর থানা পুলিশ। মামলায় স্বামী, শ্বাশুড়ী, ননদ ও দুলাভাইকে আসামি করা হয়। পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি। অভিযানে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের জামিন নিয়েছেন। সেদিন থেকে এক মাসের মধ্যে নিম্ন আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। রিমার বাবা জানান, সাদ্দামের দুলাভাই মাসুদ গাজী (৪০) ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে কাজ করেন। তিনি মূলত প্রভাব বিস্তার করছেন।
এ বিষয়ে জানতে মৃত রিমার স্বামী সাদ্দাম হোসেনের দুটি নাম্বারে কল করা হলে দুটি নাম্বারেই বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহেশ চন্দ্র সিংহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমরা অনেক কিছুই করেছি তা তদন্তের স্বার্থে বলছি না।’
সারাবাংলা/ইউজে/একে