চিড়িয়াখানায় পশু-পাখির নিঃসঙ্গ জীবন
৭ মে ২০২৩ ১৯:০৩
ঢাকা: মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় বছরের পর বছর সঙ্গীহীন জীবন কাটাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি। বর্তমানে চিড়িয়াখানায় ১৩৩টি প্রজাতির ৩ হাজার ৩৩৮টি পশু-পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি বড় প্রজাতির পশুসহ অন্তত অর্ধশতাধিক পশু-পাখি বিপরীত লিঙ্গের অনুপস্থিতিতে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছে। শুধু তাই নয় সঙ্গীবিহীন বেশ কয়েকটি প্রজাতির পশুপাখি এরইমধ্যে মারা গেছে। ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে বেশ কয়েকটি প্রাণী।
এসব প্রাণীগুলোকে সঙ্গ দিতে কখনও কখনও ঘোড়ার সঙ্গে গাধা, গণ্ডারের সঙ্গে ভেড়া দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রাণিগুলোর মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসেনি। এমন কি কোনো পশু-পাখি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সঙ্গীবিহীন বসবাস করায় বিপরীত লিঙ্গবিহীন এসব প্রাণীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনো কোনো পশুপাখি সঙ্গীবিহীন থাকায় অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
চিড়িয়াখানায় বিপরীত সঙ্গীবিহীন অথবা জোড়াবিহীন প্রাণিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, অফ্রিকান গণ্ডার (ফিমেল ১টি), ওয়াল ডিবিস (২টি ফিমেল), ক্যাঙ্গারু (২টি ফিমেল), এশিয়ান সিংহ (১টি ফিমেল), চিত্রা হায়েনা (১টি ফিমেল), অলিভ বেবুন (মেইল ১টি), হামাদ্রিয়ান বেবুন ( মেইল ১টি), সাদা হনুমান (মেইল ১টি), উল্লুক (ফিমেল ১টি), মার্স কুমির ( মেইল ১টি), কেশোয়ার (মেইল ১টি)। এই রকম ১১টি বড় প্রাণী কোনোটির পুরুষ থাকলেও নারী নেই। আবার কোনোটির নারী থাকলেও পুরুষ নেই। এ ছাড়াও চিড়িয়াখানা সঙ্গীবিহীন আরও কয়েকটি প্রজাতির সঙ্গীবিহীন অবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক সাম্ভাব হরিণ (স্ত্রী), মেছো বিড়াল ১টি (স্ত্রী), বন বিড়াল ২টি (স্ত্রী), ভোদর ১টি (স্ত্রী), গোখড়া সাপ ২টি (স্ত্রী), দাঁড়াস সাপ ১টি (স্ত্রী), হলুদ টিয়াসহ (১টি স্ত্রী), আরও বেশ কিছু প্রাণী।
এ ব্যাপারে জাতয়ি চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এইসব প্রাণীগুলোকে সঙ্গী দেওয়ার জন্য আমরা কিছু প্রাণী আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতির কিছু বিধিনিষেধ থাকায় আমরা প্রাণীগুলো আমদানি করতে পারছি না। ফলে এসব প্রাণীগুলোর সঙ্গী এ বছরও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা আশা করছি, বৈশ্বিক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হলে এসব প্রাণীগুলোর সঙ্গী দেওয়া সম্ভব হবে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো প্রাণীর ২০১৪ সাল থেকে কিংবা তারও অনেক আগে থেকেই বিপরীত লিঙ্গের কিংবা একেবারেই সঙ্গীবিহীন অবস্থায় আছে। আবার কোনোটির ৬ মাস, কোনোটির এক বছর হয়েছে এমন অনেক প্রাণীও আছে যাদের কোনো সঙ্গী নেই।’
সঙ্গী না থাকার কারণে প্রাণীগুলোর আচার আচরণে কী ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সব প্রাণী মানুষের মতোই সঙ্গী চায়, আবার অনেক প্রাণী দলবদ্ধভাবে চলাচলে পছন্দ করে। ফলে কোনো প্রাণীর সঙ্গী না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই তারা কিছুটা বিমর্ষ থাকে। তবে আমরা তাদেরকে সঙ্গী দেওয়ার চেষ্টা করছি। যখন গণ্ডারের যখন সঙ্গীহীন হয়ে পড়েছিল তখন সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। এক সময় তার সঙ্গী হিসেবে একটি ভেড়া দেওয়া হয়। তখন সে খাবার দাবার গ্রহণ শুরু করে।’
সূত্র জানায়, সঙ্গীবিহীন খাকায় চিড়িয়াখানার একমাত্র পুরুষ শিম্পাঞ্জীটি দীর্ঘ দেড় দশক চিড়িয়াখানায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে কয়েকবছর আগে মারা গেছে। একইভাবে পুরুষ ও স্ত্রী সঙ্গীবিহীন থাকায় গত কয়েক বছরে মারা গেছে চারটি স্ত্রী সাম্ভা হরিণ, ১টি স্ত্রী হায়েনাসহ বেশ কয়েকটি মুল্যবান প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বেঁচে থাকা বিপরীত লিঙ্গবিহীন এসব পশু পাখির কোনটি পুরুষ সঙ্গীবিহীন, আবার কোনটি স্ত্রী সঙ্গীবিহীন অবস্থায় বেড়ে উঠছে। নিঃসঙ্গ এসব প্রাণীগুলো সঙ্গীর অভাব পূরণে প্রাণী সম্পদ অধিদফতর থেকে নতুন পশুপাখির ক্রয় করার জন্য বেশ কয়েকবার প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সর্বশেষ ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে চিড়িয়াখানায় এসব প্রজাতির পশুপাখি বিপরীত লিঙ্গের অনুপস্থিতিতে এককভাবে বসবাস করায় বেশ কিছু প্রাণিকুলের বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে না। তাছাড়া সঙ্গীবিহীন অবস্থায় কোনো পশু পাখিকে বছরের পর বছর রাখা, চিড়িয়াখানার মূলনীতির পরিপন্থী এবং নির্দয় আচরণ বলে জানিয়েছেন চিড়িয়াখানার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের মতে, একাধিক পশু একাকিত্বের কারণে একদিকে যেমন প্রাণিকুল নির্জীব থাকে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও পরিলক্ষিত হয়। ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণিকুলের আচরণগত পরিবর্তনসহ বিভিন্ন রকম রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে করে স্বাভাবিক আয়ুকাল কমে যায়।
সূত্র জানায়, বর্তমানে জাতীয় চিড়িয়াখানায় ১৩৩টি প্রাজাতীর ৩ হাজার ৩৩৮টি বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে মাংসাশী প্রাণী ১১ প্রজাতির ৩৩টি, বৃহৎপ্রাণী তৃণভোজী ১৮ প্রজাতির ৩১৬টি, ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণী ১৫ প্রজাতির ১৯০টি, সরীসৃপ ৯ প্রজাতির ৬৪টি,পাখি ৫৬ প্রজাতির ১ হাজার ১৫১টি, মোট প্রাণী ও পাখির সংখ্যা ১০৯ প্রজাতির ১ হাজার ৭৫৪টি, অ্যাকুরিয়ামে রক্ষিত মংস প্রজাতিসমূহ ২৬ প্রজাতির ৯৩৯টি। এসব পশু পাখির জন্য চিড়িয়াখানায় ১৪০টির মতো খাঁচা রয়েছে এবং খাঁচার প্রকোষ্টের সংখ্যা ২৩৭টি।
দর্শনার্থীদের বিনোদন, দুর্লভ ও বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী সংগ্রহ ও প্রজনন, শিক্ষা-গবেষণা প্রাণী বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৬১ সালে রাজধানীর মিরপুর ঢাকা চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৬ দশমিক ৬৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত চিড়িয়াখানাটি ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
সারাবাংলা/জিএস/একে