৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত, ৮৬০ কিমি দূরে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’
১২ মে ২০২৩ ২১:৪৮
ঢাকা: ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ কক্সবাজার সমুদ্র বন্দর থেকে মাত্র ৮৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। এখন গতিবেগ ১৬০ কিলোমিটারে পৌঁছেছে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, এটি রাতে আরও বাড়বে। রোববার (১৩ মে) দুপুরে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এরপর মিয়ানমারের উত্তর উপকূল দিয়ে এটি অতিক্রম করতে পারে। এই আশংকা থেকে দেশের সমুদ্র বন্দরে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছে।
সমুদ্রে পর্যটক নামতে নিষেধাজ্ঞা: এদিকে, ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটক নামতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
সী সেফ লাইফ গার্ড সংস্থার সিনিয়র লাইফ গার্ড কর্মী আবদুস সালাম জানিয়েছেন, প্রশাসনের নিদের্শনা অনুযায়ী কাউকে পানিতে নামতে দেওয়া হচ্ছে। সাগর স্বাভাবিক পরিস্থিতির চেয়ে ক্রমাগত উত্তাল হতে শুরু করেছে। তা আরও বাড়তে পারে। সার্বিক নিরাপত্তা সৈকতে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। তাদের সঙ্গে বিচ কর্মী ও ট্যুরিস্ট পুলিশ রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে মাছ শিকারে যাওয়া ট্রলারগুলো গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, এরই মধ্যে কক্সবাজার উপকূলে নোঙর করা হয়েছে ৪ হাজারের বেশি ট্রলার। বাকি আরও দেড় হাজার ট্রলার ফেরার পথে।
পাঁচ বোর্ডে পরীক্ষা স্থগিত: ঘুর্ণিঝড় ‘মোখা’র কারণে আগামী ১৪ মে’র এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি প্রফেসর তপন কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
সেখানে বলা হয়, ঘুর্ণিঝড় ‘মোখা’র কারণে যেন চলমান এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ২০২৩ চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড, বরিশাল শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আগামী ১৪ মে রোববার অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষাসমুহ স্থগিত করা হলো। তবে অন্যান্য বোর্ডের পরীক্ষা যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে।
সাগর ছাড়ছে লাইটার জাহাজ: ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাব মোকাবিলায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব ‘অ্যালার্ট-টু’ জারি করেছে। তবে এখনও বন্দরের জেটি এবং বহির্নোঙরে পণ্য ওঠানামা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশ উপকূলের কাছাকাছি আসার পরিপ্রেক্ষিতে আবহাওয়া অধিদফতর চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত জারির পর বন্দর কর্তৃপক্ষ এ পদক্ষেপ নিয়েছে।
এদিকে ক্রমশ সাগর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে গভীর সাগর থেকে কয়েক’শ লাইটার জাহাজ কর্ণফুলী নদীতে নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরত এসেছে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌরুটে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্য পরিবহন কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাসও সীমিত হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আবহাওয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ছিলাম। চার নম্বর সিগন্যাল জারির পরপরই আমরা অ্যালার্ট-টু দিয়েছি। সাইক্লোন স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের সংকেতের ওপর নির্ভর করে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। সংকেত বাড়লে পর্যায়ক্রমে জাহাজ চলাচল ও পণ্য খালাস বন্ধ করে দেওয়া হবে। বন্দর জেটি, চ্যানেল ও হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট ঘূর্ণিঝড়ের কারণে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেব।’
পাহাড়-উপকূল থেকে বাসিন্দাদের সরাতে মাইকিং: জানমালের ক্ষতি কমাতে উপকূলীয় এলাকা, সাগর তীরবর্তী জেলে পাড়া এবং নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে চলে যেতে মাইকিং করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা হোছাইন মোহাম্মদ সারাবাংলাকে জানান, পতেঙ্গা, আকমল আলী রোডের বেড়িবাঁধসংলগ্ন জেলে পাড়া ও রাণী রাসমনিঘাটসহ নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে দুপুর থেকে মাইকিং করে স্থানীয় বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছেন। যারা সরিয়ে নেননি তাদের অতিদ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।
যা বলছে আবহাওয়া অধিদফতর: আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকার (১৪.৫° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৫° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি শুক্রবার (১২ মে) সন্ধ্যা ০৬ টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১৩০ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৯০ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরো উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে রোববার (১৪ মে) সকাল ০৬ টা থেকে সন্ধ্যা ০৬ টার মধ্যে কক্সবাজার-উত্তর মায়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
শনিবার (১৩ মে) সন্ধ্যা থেকে কক্সবাজার ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’-এর অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কি.মি. এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৪০ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৬০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুদ্ধ রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দর সমূহকে ০৪ (চার) নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৮ (আট) নম্বর মহাবিপদ সংকেত (পুনঃ) ৮ (আট) নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৪ (চার) নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারী সংকেত (পুনঃ) ৪ (চার) নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারী সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৮ (আট) নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা ফেনী, নোয়াখালী চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অনুরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত থাকতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক আজিজুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুদ্ধ। রোববার (১৪ মে) দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
সারাবাংলা/জেআর/একে