সোনালি ধানে কৃষকের মুখে হাসি, উৎপাদন ২ কোটি টনের বেশি
১৬ মে ২০২৩ ২৩:০০
ঢাকা: হাওরে এবার আগাম বন্যা হয়নি। কালবৈশাখী ঝড়ের কবলেও পড়তে হয়নি কৃষিজমিকে। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্যের তাপদাহও ধরা দিয়েছে যেন আশীর্বাদ হয়ে। কোনোরূপ ঝড়-ঝঞ্জা ছাড়াই মাঠের বোরো ধানের পুরোটাই ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষক।
এবার বোরো ধানের উৎপাদনও বেশ ভালো হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদনও বেশি হবে বলে প্রত্যাশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
মৌসুমটিতে ২ কোটি ২০ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে বলে প্রত্যাশা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের। গ্রাম-গঞ্জে এবার বোরো ধানের দামও রয়েছে ভালো। প্রকারভেদে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে ধান। উৎপাদন ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরাও বেজায় খুশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার নির্বিঘ্নে হাওরের ধান উঠানো গেছে। এখন রাজশাহী ও দিনাজপুরের কিছু কিছু জায়গায় ধান কাটা চলছে। সরিষা কেটে যেখানে (লেট ভ্যারাইটি) ধান রোপণ করা হয়েছিল, সেখানে এখন ধান কাটা চলছে। এ বছর বোরো ধানের চমৎকার ফলন হয়েছে। এবার রোদ বেশি, গরম বেশি হলেও- ধানের উৎপাদন হওয়ায় চাষিরাও খুশি। কৃষকরা বলছেন, তাদের একটি খড়ও নষ্ট হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ১৬ লাখ টন। আমরা আশা করছি, মোট উৎপাদন হবে ২ কোটি ২০ লাখ টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার বোরো ধানের উৎপাদন বেশি হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মৌসুমের প্রথম দিকে ২৮ ও ২৯ ধানের ফলন কম হয়েছিল। এ দুটি জাতে ব্লাস্টও দেখা দেয়। আমরা আগামী বছর থেকে ২৮ ও ২৯ এর বীজ উৎপাদন নিরুৎসাহিত করব। এখন বোরোতে নতুন জাতের ধান উৎপাদনকে উৎসাহিত করব।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, সারাদেশে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছিল ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত ধান কাটা হয়েছে ৪১ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমির। কর্তনের হার ৮২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সমপরিমাণ জমিতে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ৪ দশমিক ৩২ টন। কেটে ফেলা ৪১ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭৮ লাখ ৪২ হাজার টন চাল। এবার চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ ৩৩ হাজার টন।
এদিকে, হাওরভুক্ত দেশের ৭ জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৯ লাখ ৮৭ হাজার টন। এ বছর হাওরে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। এখন পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৯ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমির ধান। হেক্টর প্রতি চালের গড় উৎপাদন ৪ দশমিক ২০ টন। সমপরিমাণ পরিমাণ জমিতে ৩৮ লাখ ৯৬ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। শুধুমাত্র হাওরে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৮ লাখ ৮০ হাজার টন, উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ ১৪ হাজার টন চাল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর বোরো ধানের চমৎকার ফলন হয়েছে। ফলন খুবই ভালো হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার ফলন বেশি হবে। এবার প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ১৬ লাখ টন। আমরা আশা করছি লক্ষ্যমাত্রা তো পূরণ হবে বটেই, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চালের উৎপাদনও বেশি হবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এবার এখন পর্যন্ত হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪ দশমিক ৩২৭ টন। সাধারণত বোরোতে উৎপাদন ৪ টনের বেশি হয়ে থাকে। গত বছর হেক্টর প্রতি উৎপাদন ছিলে ৪ দশমিক ২৩ টন। অর্থাৎ বোরোতে এবার গড় ফলন অনেক ভালো।’
কৃষকরাও তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কৃষক মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঝড় বৃষ্টি না হওয়ার এবার ধানের ক্ষতি হয়নি। মাঠে উৎপাদিত সব ফসল ভালোভাবে ঘরে তুলতে পেরেছি। এবার ধানের উৎপাদনও অন্য বারের চেয়ে ভালো। প্রতি মণ (৪০ কেজি) ধান ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার হরশী গ্রামের কৃষক হিমেল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালোভাবে ধান উঠাতে পেরেছি। এক কানি (২০ শতাংশ) জমিতে ১৪ মণের মতো ধান হয়েছে। ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা মণে ধান বিক্রি হচ্ছে।’
এদিকে, নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের কৃষক মো. শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বোরোর ফলন ভালোই হয়েছে। ঝড় বৃষ্টি ছিল না। কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে শ্রমিকের দাম অনেক বেশি। দৈনিক ১২০০ টাকা হাজিরা দিয়ে ধান কাটাতে হয়েছে। এবারই প্রথম একজন শ্রমিকের জন্য দিনে ১২০০ টাকা দিতে হয়েছে। আমাদের এখানে এক কানি (৩০ শতাংশ) জমিতে ১৫ থেকে ১৬ মণ (৪৮ কেজি) ধান হয়েছে। ধান বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকা মণে (৪৮ কেজি)।’
নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার কৃষক কাজল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাওরে এবার বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। তবে ব্রি ধান- ২৮ ও ২৯ এর ফলন খুব খারাপ হয়েছে। তবে যারা ৮৮ ও ৮৯ ধান করেছে তাদের ফলন ভালো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে কাঠা (১০ শতাংশ) প্রতি ৫ থেকে ৭ মণ ধান হয়েছে। প্রতি মণ (৪২ কেজি) ধান ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে