ভয়াবহ রূপ নিয়ে আসছে ডেঙ্গু!
১৯ মে ২০২৩ ০৯:৫০
ঢাকা: বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার ভয়াবহ হতে যাচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত পাঁচ মাসের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৮ মে পর্যন্ত যে সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এর আগে কোনো বছরের প্রথম পাঁচ মাসে এমনটা দেখা যায়নি।
তথ্যমতে, ১৮ মে পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২ জন। ২০০০ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রথম পাঁচ মাসে এতো মৃত্যু আর কখনো দেখেনি বাংলাদেশ।
শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি অন্য সময়ের তুলনায় খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীও।
ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন ধরণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা চিকিৎসকদের। একই আশঙ্কা প্রকাশ করে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নিয়ে ভাবার চাইতেও বেশি জরুরি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা। এমনটা না হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে পুরো দেশজুড়েই।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে এক হাজার ৩৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮১৮ জন। এর মাঝে সর্বোচ্চ ১৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর মাঝে একজন মারা গেছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৩২ জন রোগী চিকিৎসাধীন। এছাড়াও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সর্বোচ্চ চারজন ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুইজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মাঝে কাকরাইলের ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে একজন ও আজগর আলী হাসপাতালে একজন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
ঢাকা মহানগরীর বাইরে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৪১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত। এর মাঝে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলা শহরগুলোতে ৮৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ২৫৮ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে মারা গেছেন তিনজন। ময়মনসিংহ বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও কেউ মারা যায় নি। খুলনা বিভাগে এখন পর্যন্ত ৪২ জন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এছাড়া রাজশাহী বিভাগে সাতজন, রংপুর বিভাগে দুই জন, বরিশাল বিভাগে ১২৫ জন ও সিলেট বিভাগে চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে এসব বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম।
প্রথম পাঁচ মাসেই ছাড়িয়েছে অতীতের সব রেকর্ড:
চলতি বছর জানুয়ারি মাস থেকেই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। শুধু আক্রান্তই না, চলতি বছরের ১৮ মে পর্যন্ত ইতোমধ্যেই মারা গেছেন ১২ জন। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্তের পরে প্রথম পাঁচ মাসে এতো মৃত্যু কখনো দেখা যায় নি।
শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয় বরং দেশের অন্যান্য স্থানেও চলতি বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে চিকিৎসা নিতে। ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে ইতোমধ্যেই তিনজন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
১৮ মে পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৩৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পরে প্রথম পাঁচ মাসে এটিই সর্বোচ্চ শনাক্তের তথ্য।
২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৫২ জন। তবে এই পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায় নি। এ বছর জুন মাসে প্রথম ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও বছর শেষে ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এটি এক বছরে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান।
২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০০ জন। তবে এই পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায় নি।
২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩০৬ জন। তবে এই পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায় নি।
২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩২৪ জন। তবে এই পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দুই জন মারা যাওয়ার তথ্য জানানো হয় সরকারিভাবে।
সাধারণত বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ শুরু হয়ে থাকে জুন-জুলাই মাসের দিকে। কারণ, এ সময়টিতে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। অক্টোবর মাস থেকে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ কমতে থাকে বলেও ধারণা করা হতো ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত।
কিন্তু ২০২২ সালের নভেম্বরেও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯ হাজার ৩৩৪ জন রোগী। এ মাসে ১১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান যা এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান।
শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই ডেঙ্গুর ঝুঁকি:
ঢাকার ১০০টি বাড়ির মধ্যে চারটিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ড, যেখানে মশার ঘনত্ব বা ব্রুটো ইনডেক্স ২৪.৩৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার অধীনে ‘জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’র আওতায় পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে এসব তথ্য জানা গেছে। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ৯৮টি ওয়ার্ডে এই জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে উত্তর সিটির ৪০টি এবং দক্ষিণ সিটির ৫৮টি ওয়ার্ডের তিন হাজার ১৫০টি বাড়িতে জরিপ করা হয়। জরিপে ১২৭টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, যা ৪.০৩ শতাংশ।
জরিপে দেখা গেছে, বহুতল ভবনে এডিস মশার ঘনত্ব ছিল ৩৯.৩৭ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবনে ৩২.২৮ শতাংশ, পানিপূর্ণ ফ্লোরে ২৫.৫২ শতাংশ, প্লাস্টিক ড্রামে ১১.৭২ শতাংশ, প্লাস্টিকের বালতিতে ৯.৬৬ শতাংশ ও মিটারের গর্তে ৯.৬৬ শতাংশ।
ডিএনসিসি’র ৩.৩৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশা : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩.৩৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৪০টি ওয়ার্ড পরিদর্শন করে পাঁচটি ওয়ার্ডকে মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। চারটি ওয়ার্ড অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো হলো ৩, ২৩, ২৬ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড।
ডিএসসিসি’র ৪.১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশা : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪.১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৫৮টি ওয়ার্ড পরিদর্শন করে ১৩টি ওয়ার্ডকে মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। চারটি ওয়ার্ড অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো হলো ২, ১২, ১৬ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড।
জরিপে বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে যে মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, এর ৯৯.১৪ শতাংশ এডিস ইজিপ্টি এবং শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ এডিসএলবো পিক্টাস জাতের। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক মূলত এই দুই ধরনের মশা। এর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু বেশি ছড়াচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ঢাকাকেন্দ্রিক এ ধরনের জরিপ দিয়ে সার্বিক ভবিষ্যদ্বাণী করা ঠিক হবে না। কারণ পুরো বাংলাদেশেই এখন ডেঙ্গুর হটস্পট। তাই শুধু ঢাকা শহর নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে মারা যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সামনে যেহেতু বৃষ্টি হবে, তাই আগেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
ধরন পাল্টে ভয়ংকর রূপে ডেঙ্গু:
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে যেসব রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল তাদের অধিকাংশই ডেন-থ্রি সেরোটাইপে আক্রান্ত ছিল। কোথাও কোথাও ডেন-ফোরের উপস্থিতিও পাওয়া যায়। যারা আগে এক বা একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা ডেন-থ্রি এবং ডেন-ফোরে আক্রান্ত হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি জটিল রূপ নেওয়ায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এমনকি যারা মারা যায় এবার তাদের বেশিরভাগকেও ডেন-থ্রি ও ডেন-ফোরে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু সেরে যায়। তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। গতবছরের ডেঙ্গু রোগীদের বেশিরভাগ ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে পরিণত হচ্ছিল। ফলে, আক্রান্তের পাঁচদিন পর রোগী যখন মনে করে সে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে তখনই তাদের অবস্থা খারাপ হয়। জ্বর যখনই কমে আসছে, রোগীর রক্তচাপও কমে যাচ্ছে। সে সময়ে ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন সারাবাংলাকে বলেন, গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে কক্সবাজারে ডেঙ্গুর স্ট্রেইন ৩, ৪ ও ১-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সারাদেশেই কিন্তু মানুষের যোগাযোগ এখন বাড়ছে নানা কারণে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে উন্নয়নমূলক কাজও চলছে। ফলে ডেঙ্গুর সবধরন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যদি কয়েকটি সেল টাইপ একসঙ্গে থাকে, তাহলে আক্রান্তের আশঙ্কা বেশি থাকে; সিভিয়ার ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দেয়।
তিনি বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে আইইডিসিআর ডেঙ্গুর সেল পর্যবেক্ষণ করছে। এ পর্যন্ত ভাইরাসের চারটি ধরন পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমাদের সার্কুলেশনে স্ট্রেইন-১ ও ২ ছিল। ২০২১ সালে স্ট্রেইন ৩-এর প্রকোপ দেখা দেয়। কিন্তু ২০২২ সালে স্ট্রেইন ৪-এর উপস্থিতি মিলেছে। এবার ঢাকায় ডেন-ফোরের উপস্থিত পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে ডেন-ওয়ান, ডেন-থ্রি ও ডেন-ফোর সেরোটাইপ ডেঙ্গু হচ্ছে। একাধিক সেরোটাইপে সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি হয় ২০২২ সালে। তবে আমরা এ বছরের পরিস্থিতি এখনো পর্যবেক্ষণ করছি।
ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. একরামুল হক বলেন, ‘২০২২ সালে আমরা প্রথমবারের মতো ডেন-৪ ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাই, যা অবশ্যই উদ্বেগজনক। অন্যান্য বছর অক্টোবর থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করলেও গত বছর তেমনটা হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়ে বৃষ্টিপাত ও যেখানে-সেখানে পানি জমে থাকার কারণে মশার বংশবৃদ্ধির সুযোগ ঘটে। এর ওপর ধরন পাল্টানোতেও ভয়াবহতা বাড়ছে। সবমিলিয়ে আমাদের আসলে রিল্যাক্স মুডে থাকার কোনো উপায় নেই। এডিস মশার বিস্তার রোধে আমাদের অবশ্যই কাজ করে যেতে হবে সবসময়।
রাজধানীতেই ডেঙ্গুর হটস্পট
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, রাজধানীতে বেশ কয়েকটি ডেঙ্গুর হটস্পট রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এডিস মশা রয়েছে মুগদা এলাকায়। এছাড়া যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, পোস্তগোলা, ধানমণ্ডি, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। এসব এলাকায় অনেক বেশি পরিমাণে ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগী ভর্তি হওয়ার তথ্য বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
সংক্রমণ পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, অন্যান্যবারের তুলনায় এবার জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত রোগীর যে সংখ্যা দেখা গেছে তা উদ্বেগজনক। এই সময়ে ১২ জন মারা গেছে যা অবশ্যই অপূরণীয় ক্ষতি। অথচ এখন পর্যন্ত কিন্তু বৃষ্টি তেমনভাবে শুরু হয় নি। আর তাই সামনের দিনগুলোতে সবাই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।
তিনি বলেন, হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তা হলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগীর হার সমান নয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি, সেখানে মশক নিধনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাইকিং, জনসচেতনতা, ওষুধ ছিটানো— সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে। এমনটা না করতে পারায় এখন পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু।’
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, আমরা একটা জরিপ করে দেখেছি যে, এদেশের মানুষ এডিস মশা কীভাবে হয়, প্রজননস্থল, বদ্ধ, স্বচ্ছ পানি- এই সবকিছুই জানে। তারপরও তারা সচেতন হন না। এটা একটা মানসিকতা। এর পরিবর্তন দরকার। আর সিটি করপোরেশন যতই বলুক তারা মশার উৎস ধ্বংস করছে। কিন্তু উড়ন্ত এডিস মশা থেকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন কিন্তু ডেঙ্গু শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়েছে। আর তাই সারা দেশেই স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য। নতুবা পরিস্থিতি আসলে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকেই আমাদের মশার প্রজনন ঠেকাতে হবে। মশার প্রজনন যদি আমার মৌসুমের শুরুতেই ঠেকাতে পারি, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসা বাড়ি বা আশপাশে যেন পানি জমা না থাকে, পানি জমার মতো কোনো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, কোথাও যেন পরিত্যক্ত টায়ার বা কোনো ধরনের পাত্র পড়ে না থাকে, এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ধ্বংস করতে হবে মশার প্রজননক্ষেত্র:
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। যেহেতু সামনে আরো নগরায়ণ হবে, আরো উন্নয়ন হবে, আমাদের আগেভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’
ডেঙ্গু সংক্রমণ বিষয়ে সতর্ক করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কিছু দিন ধরে ফের ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রভাব বাড়ছে। এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে হলে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘সবাইকে নজর রাখতে হবে যে, বাসাবাড়ির ছাদ ও আঙিনায় যেন পানি জমে না থাকে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’
সারাবাংলা/এসবি/ এনইউ