।| ইব্রাহীম মল্লিক সুজন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সদ্য প্রকাশিত মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল বিগত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ম। এবার অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৭০। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই ফেল করেছে ইংরেজি ও গণিতে বিষয়ে। এর মধ্যে প্রায় তিন লাখই মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী।
মানবিকে ফেল করার ফলে এর প্রভাব পড়েছে এবারের সামগ্রিক ফলাফলে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে মানবিকের শিক্ষার্থী বেশি হলেও সে অনুযায়ী ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক না থাকায় ফলাফলের এমন বিপর্যয়। তাদের মতে, শহরাঞ্চলের মতো গ্রামের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এ দুই বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিত করা না গেলে ফলাফলের এমন বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ৮টি সাধারণ বোর্ডে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাশের হার যথাক্রমে ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬৯ শতাংশ এবং ৮০ দশমিক ৯১ শতাংশ।
মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিলো মোট সাত লাখ ১৯ হাজার ৬৭৬ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৬ পাস করে। অন্যদিকে বিজ্ঞানে অংশ নেওয়া ৫ লাখ ৩ হাজার ৫০৬ জনের মধ্যে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬০২জন শিক্ষার্থী পাস করে। এছাড়া ব্যবসায় শিক্ষায় অংশ নেওয়া ৪ লাখ এক হাজার ২৪১ জনের মধ্যে মোট ৩ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৭ জন শিক্ষার্থী পাস করে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গত বছরের তুলনায় এ বছর বিজ্ঞান শাখায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৮১ হাজার ৩৫১ জন বেড়েছে এবং ৭৪ হাজার ৫৩০ জন বেশি পাস করেছে। বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ-৫ এর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এ বছর ৫ হাজার ৭৪২ জন বেড়েছে। অন্যদিকে মানবিকে জিপিএ-৫’র পাশাপাশি পাসের হার কমেছে।
ঢাকার মতো রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট এবং দিনাজপুর বোর্ডেও পাশের হারের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ। এসব বোর্ডে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ। মানবিক বিভাগ রয়েছে সবার পেছনে। ফলাফলে সব থেকে খারাপ করেছে চট্টগ্রাম বোর্ড। সেখানে মানবিকে পাসের হার ৬০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই পাস-ফেলের প্রধান অনুঘটক হয়ে ওঠে গণিত ও ইংরেজি। এ দুটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা খারাপ করলে, সে বছর সার্বিক ফলাফলও খারাপ হয়। এ বছরও ঠিক সেটিই ঘটেছে। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের ফল বিপর্যয়ের কারণেই সার্বিক পাশের হারে এরকম ধাক্কা লেগেছে। তারা বলছেন, যেসব বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও গণিতে দক্ষ শিক্ষক নেই সে সব বিদ্যালয়ে ফেলের হার বেশি।
এ বিষয়ে কথা হয় ফরিদপুরের মধুখালী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক মনিরুজ্জামান মামুনের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, গ্রাম এলাকায় অপেক্ষাকৃত গরীব ও পিছনের দিকের শিক্ষার্থীরা মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়ে থাকেন। দেখা যায় যে গণিত, বাংলা, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে তারা খুবই দুর্বল হয়। এক্ষেত্রে ক্লাসের বাইরেও তাদের বিশেষ সহায়তা দরকার হয়। অনেক শিক্ষক এই সময়টা দেন না। আবার শিক্ষার্থীদের দিক থেকেও আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। তারা এখন মুঠোফোন ও ফেসবুক নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে, তাই দুর্বল বিষয়ে ভাল করার বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম দেখা যায়। এসব কারণেই ফল খারাপ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ বছর শুধু ঢাকা বোর্ডেই ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পাসের হার ৪ শতাংশ করে কমেছে। মূলত ইংরেজি ও গণিতের পার্থক্যই ফলকে নিম্নমুখী করেছে বলে বিভিন্ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার সব থেকে বেশি বিজ্ঞান বিভাগে ৯৩ দশমিক ৫২ শতাংশ, এরপর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৮২ দশমিক দুই শতাংশ এবং সব থেকে কম মানবিক বিভাগের ৭১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকার রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বিজ্ঞানে ভালো ফলাফল কাঙ্ক্ষিত হলেও সেটি অন্য বিভাগকে খারাপ করে নয়। বরং যারা মানবিক বা অন্য কোনো বিভাগ থেকে পড়াশোনা করছে তাদেরকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগের আসন সংখ্যা বেশি। কর্মক্ষেত্রেও মানবিক বিভাগ থেকে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে নেই। তাই সবাইকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য দিন দিন বাড়বেই।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এম এ হাকিম সারাবাংলাকে বলেন, কোটা সংস্কারের আন্দোলনের আগে শিক্ষানীতি নিয়ে আন্দোলন হওয়ার দরকার ছিলো। আমাদের দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য কমানো যায়নি। এখনও আমরা একমুখী শিক্ষানীতি চালু করতে পারিনি। ইংরেজি বাংলা মিলে একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে।
ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণে বিপুল ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘মানবিকসহ সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে দক্ষ করতে তুলতে হলে সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে।’
সারাবাংলা/এমআইএস/এমএস