Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেতন বাড়ার খবর নেই, দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ ২৬ মে

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২০ মে ২০২৩ ২০:৫৫

ঢাকা: এটা পরিষ্কার যে, আসছে বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো কিংবা মহার্ঘ ভাতা কোনোটিই থাকছে না। তবে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। আর তা হবে মুল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি অর্থ মন্ত্রণালয়কে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনো তাদের কাছে কোনো দিক-নির্দেশনা আসেনি।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, নবম পে-স্কেল বাস্তবায়ন, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, বেতন জ্যেষ্ঠতা পুনর্বহাল, কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণসহ সাত দফা দাবিতে আগামী ২৬ মে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ। তারা বলছেন, সরকারি নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনেই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।

নিয়ম অনুযায়ী, পাঁচ বছর পর পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করার কথা। সেই হিসাবে ২০২০ সালে নবম বেতন কাঠামো পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে তা হয়নি। তবে সর্বশেষ ২০১৫ সালে অষ্টম বেতন কাঠামো ঘোষণা হলেও প্রতিবছর সরকারি চাকরিজীবীরা পাঁচ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন।

এদিকে, করোনা মহামারি পর নতুন করে শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যে কারণে বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল। এতে সারাবিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও সবধরনের পণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে দাবি উঠেছে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার। এই পরিস্থিতিতে বাজেটকে সামনে রেখে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই সময় আশা করা হচ্ছিল, বাজেট চূড়ান্তকরণ বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। কিন্তু তা হয়নি।

বরং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপান সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন, মহার্ঘ ভাতা (সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য) বলে কিছু নেই। মূল্যস্ফীতি যত বাড়বে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা একটি পার্সেনটেজে বেতন বাড়াই। তাছাড়া আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছি।

বিজ্ঞাপন

বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজেট ঘনিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেটসংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ এক ভাতার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি আর এগোয়নি। এমনকি নতুন সিদ্ধান্তের আলোকে কোনো দিক নির্দেশনা আসেনি। তবে নতুন বেতন কাঠামো কিংবা মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিষয় থাকছে না।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সরকার সর্বশেষ জাতীয় বেতন কাঠামো ঘোষণা করে ২০১৫ সালে। যা এখনও চলছে। কিন্তু গত আট বছরে গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সবধরনের জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে শতকরা প্রায় ৪০ শতাংশ। অথচ সে তুলনায় বাড়েনি মানুষের আয়।

সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবছর একটা ইনক্রিমেন্ট হিসেবে বেতন বেড়েছে পাঁচশ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকার অংকে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে পাঁচ হাজার টাকা বা তারও বেশি। সরকারি চাকরিজীবীরা বলছেন, বর্তমান বেতন কাঠামোতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় কম বেতনভুক্তদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, মুল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে এবার ৭ দফা দাবি আদায়ে মাঠে নামছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। সরকারি চাকরিজীবীদের ১২টি সংগঠন একত্রিত হয়ে গঠন করেছে ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ’। এই পরিষদের ব্যানারে আগামী ২৬ মে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সকাল ১০টায় মহাসমাবেশ করবেন তারা।

৭ দফা দাবি হলো

১. পে-কমিশন গঠনপূর্বক বৈষম্যমূলক নবম পে-স্কেল বাস্তবায়ন করতে হবে। পে-স্কেল বাস্তবায়নের পূর্বে অন্তর্বতীকালীন সময়ে ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিতে হবে।

২. ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী ১০ ধাপে বেতন কাঠামো নির্ধারনসহ পে-কমিশনে কর্মচারী প্রতিনিধি রাখতে হবে।

৩. সচিবালয়ের মতো সকল দফতর, অধিদফতর ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পদ ও পদবি পরিবর্তনসহ এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন করতে হবে।

৪. টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, বেতন জ্যেষ্ঠতা পুনর্বহাল এবং সকল স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের গ্রাচ্যুইটির পরিবর্তে পেনশন প্রবর্তনসহ বিদ্যমান গ্র্যাচুইটি/আনুতোষিকের হার ৯০ শতাংশের পরিবর্তে ১০০ শতাংশ নির্ধারণ ও পেনশন গ্রাচুইটি ১ টাকা থেকে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে।

৫. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়নসহ সহকারী শিক্ষকদের বেতন নিয়োগ বিধি-২০১৯ এর ভিত্তিতে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ। আউটসোর্সিং পদ্ধতি বাতিল করে উক্ত পদ্ধতিতে নিয়োগকৃত ও উন্নয়ন খাতের কর্মচারীদের রাজস্বখাতে স্থানান্তর করা।

৬. ব্লক পোস্টে কর্মরত কর্মচারিসহ সকল পদে কর্মরতদের পদোন্নতি বা ৫ বছর পর পর উচ্চতর গ্রেড দিতে হবে। অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বিচার বিভাগীয় কর্মচারী হিসেবে গণ্য করতে হবে। এছাড়া টেকনিক্যাল কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের টেকনিক্যাল পদমর্যাদা দিতে হবে।

৭. বাজার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে সকল ভাতা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর ও অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করার দাবি তাদের।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে বৈষম্য হয়েছে অষ্টম বেতন কাঠামো ঘোষণার সময়।’ বর্তমান পদ্ধতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টি হ য ব র ল করে রেখেছে। আমরা চাই এর একটি সুষ্ঠু সমাধান।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ১৯ বছর ধরে চাকরি করছি। আট বছরে একটি উচ্চতর গ্রেড পেয়েছি মাত্র। এর পর আর কোনো গ্রেড ও পদোন্নতিও পাইনি। এখন যে পদ্ধতি রয়েছে তাতে হয়তো আমাকে এই পরিস্থিতি মাথায় নিয়েই অবসরে যেতে হবে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী আমি যদি ২৭/২৮ বছর পর পদোন্নতি পাই তাহলে কোনো আর্থিক সুবিধা হবে না। কর্মকর্তারা কিন্তু নবম গ্রেডে যোগদান করে মুখ্য সচিব পর্যন্ত হতে পারছেন। একেকজনের ১০ টা পর্যন্ত পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সবাই তো মূখ্য সচিব তো হবেন না। কিন্তু তাদের অপশন রয়েছে। আমাদের কিছুই নেই।’

মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বেশি গ্রেড করে বেতনের ধাপ ছোট করে ফেলা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১০ ধাপে একটি বেতন স্কেল নির্ধারণ করেছিলেন। সেটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এর পর পর্যায়ক্রমে এটি ২২ ধাপে উন্নীত করা হয়। সবশেষ ২০১৫ সালে গ্রেড বাড়ানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘ধরুন একজনের বেতন আট হাজার টাকা। সেই কর্মচারী বছরে তার বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখি ভাতা পাচ্ছেন। এটুকুই পাচ্ছেন শুধু। ফ্ল্যাট, গাড়ি লোন সুবিধা এসব ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কোনো কর্মচারী পান না। এসব বৈষম্য দূর করা হোক।’

মহাসমাবেশ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা সরকারি কর্মচারী, সরকারের নিয়মশৃঙ্খলা মেনেই আমাদের দাবি আদায়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাব। এ বৈষম্য ৫০ বছরের। এটা দ্রুত পূরণ হবে তা আমরা আশা করি না। তবে আমাদের এই দাবি চলমান থাকবে।’

এর আগে, সরকারি চাকুরিজীবিদের জন্য আসছে বাজেটে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব তুলেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ১১ মে অনুষ্ঠিত বাজেট চূড়ান্তকরণ বৈঠকে বিষয়টি তোলা হলেও সেটি আর এগোয়নি। এর পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, গত ২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ১১ গ্রেড থেকে ২০ গ্রেডভুক্ত কর্মচারীদের টিফিন ভাতা বাড়ানোর পক্ষে প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম। আর সরকারি চাকরিজীবীদের সন্তানদের জন্য প্রদেয় শিক্ষাসহায়ক ভাতা, সরকারি কর্মচারীদের চিকিৎসা ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন নরসিংদী জেলা প্রশাসক নঈম মোহাম্মদ মারুফ।

ওই দুই জেলা প্রশাসকের প্রস্তাব আমলে নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের চিকিৎসা ভাতা, ১১ থেকে ২০ গ্রেডভুক্ত কর্মচারীদের টিফিন ভাতা আর কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এবারের বাজেটে নতুন বেতন কাঠামো কিংবা মহার্ঘ ভাতা কোনোটিই কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে।

এদিকে, সরকারি চাকরিজীবীদের নবম বেতন কাঠামো ও মহার্ঘ ভাতার দাবি দীর্ঘদিনের। গেল বছরও তারা দাবি তুলে আন্দোলনের কথা বলেছিলেন। এমনকি আসছে বাজেটকে সামনে রেখে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তারা।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

কর্মকর্তা দাবি বেতন মহার্ঘ ভাতা মহাসমাবেশ সরকারি কর্মচারী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর