টেলিগ্রাম চক্রের খপ্পরে হাজারও তরুণী, ছড়িয়ে পড়েছে ২০ হাজার ভিডিও
২২ মে ২০২৩ ১৮:১০
ঢাকা: আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম চক্রের মূল হোতাসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের ক্রিমিনাল ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। এই চক্রের সদস্যদের কাজ হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী কিংবা তরুণীদের ভিডিও ফাঁস ও তা নেট দুনিয়ায় বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এই চক্রটি দীর্ঘদিন হাজার হাজার তরুণীকে ফাঁদে ফেলেছে। চিন্তায় ফেলেছে তাদের অভিভাবকদেরও।
সোমবার (২২ মে) দুপুরে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় মালিবাগে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানান সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী।
সিআইডি জানিয়েছে- এই চক্রের মূল হোতা মার্ক ওরফে সায়েম। সে থাকে চট্টগ্রামে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর। সে শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউটের চট্টগ্রাম শাখা থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছে। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক এই চক্রের রয়েছে বিভিন্ন গোপন গ্রুপ ও পেজ। এদের ফলোয়ার সংখ্যা সোয়া ৪ লাখ। মাসে ১ থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। এই চক্রটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও ও ৩০ হাজার ছবি।
চক্রের মূল হোতা সায়েমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলো মশিউর, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট। এ ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছিলেন, তাদের ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম আইডি হ্যাক করে পমপম নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ তাদের গোপন ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে। টাকা-পয়সা দাবি করছে। দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করছে। কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভিকটিমদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিচ্ছে।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির সাইবার পুলিশের একটি দল কাজ শুরু করে। এতে দেখা যায়, গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করেছে।
ওই চক্রের সদস্যরা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর কন্টেন্ট সংগ্রহ ও সরবরাহ করত।
সিআইডি জানায়—মার্ক-সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েমকে শনাক্ত করা সহজ ছিল না। প্রযুক্তির সহায়তায় তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয় সিআইডি।
এরইমধ্যে আরাফাত নামের এক ভুক্তভোগী এবং তার প্রেমিকার কিছু ছবি পমপম গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়। পরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার ঘনিষ্ট দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেফতার করা হয়।
মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পমপম গ্রুপের সব চ্যানেল ও অ্যাডমিনদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। অ্যাডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কনটেন্ট জোগাড় করা। নতুন কনটেন্ট পেতে তারা ফেক আইডি বানিয়ে ফেসবুক বা ইন্সট্রাগ্রাম আইডি হ্যাক করত।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম চক্রকে ছবি ও ভিডিও সরবরাহ করত ভুক্তভোগী অনেক তরুণীর সাবেক প্রেমিকরা। প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর প্রতিশোধের নেশায় তাদের কাছে থাকা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে। মার্ক তার অ্যাডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করত। প্রমো দেখে যারা ফুল-ভার্সন দেখতে চায় তাদের ১ থেকে ২ হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হয়।
সিআইডি জানতে পেরেছে মার্ক-সায়েমদের বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা একং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া।
মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে কর্ণফুলি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও।
সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই এডাল্ট গ্রুপগুলোর অ্যাডমিনের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদের ধরতে বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেফতার হয় গুরুত্বপূর্ণ অ্যাডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত সর্বমোট ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি আরও বলেন, ‘মার্ক-সারারবার্গ এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার আপত্তিকর ছবি পাওয়া গেছে। এই চক্রের জড়িত বাকিদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/একে