অপার সম্ভাবনার হাওর
২৭ মে ২০২৩ ১৪:২৩
নেত্রকোনা: চিরায়ত এক গ্রামবাংলার অপার সম্ভাবনার অঞ্চল নেত্রকোনার বিশাল আয়তনের হাওর অঞ্চল।এ অঞ্চলের গ্ৰামীণ জীবনে হাওর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাওর শব্দটি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট্ট সমুদ্রের মতো বিপুল জলরাশি। হাওরের প্রকৃত রূপটি বর্ষাকালেই পুরোপুরি উদ্ভাসিত হয়। বর্ষার জলে হাওর মৌসুমে সমুদ্রের পেটের মতো ফুলে ওঠে। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি।
শহরবাসী জীবনে কখনও সমুদ্র দেখেনি তারা হাওরকে ছোট সমুদ্র মনে করে ভুল হতে পারে। হয়তবা প্রথম দেখে মনে হবে বর্ষাকালের অথৈ পানি বুঝি সারাবছরই থাকবে। আধুনিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত এখনো হাওরের মানুষ। কৃষিভিত্তিক হাওরের জনজীবনে সংকট এখনও নিত্যদিনের সঙ্গী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিত্সা, আশ্রয়, খাদ্য, যোগাযোগ কোনোটিই এখনো আলোকিত নয়। এমন কি দেশের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকার সঙ্গেও তুলনা করা যায় না।
আশার কথা, সরকার হাওর অঞ্চলে কর্মরত সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য হাওরভাতা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভেতর আসবে গণমুখী চেতনা, আসবে আন্তরিক সেবাদানের মানসিকতা। উপকৃত হবে হাওরের মানুষ, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বন্যার পানিতে ভেসে বোর ফসল তলিয়ে গেলে সরকার সহযোগিতা করেন।
আধুনিক শিক্ষার দিক থেকে নেত্রকোনার হাওর অঞ্চল এখনো অনেক পিছিয়ে আছে বলা যায়। অধিকাংশ ছেলেমেয়ে প্রাইমারি অতিক্রম করতে পারে না। প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রাইমারিতেও যায় না। যাবে কী করে? কখনো কাদাজলে হেঁটে, কখনো খেয়া নৌকায় ভেসে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া সত্যিই কঠিন। ভরা বর্ষা মৌসুমে পানিতে বিদ্যালয় তলিয়ে গেলে সরকার বন্ধ করতে বাধ্য হয় । তখন শিশুরা হাওরে সাঁতরিয়ে, মাছ ধরে সময় কাটায়।
জীবনে অশিক্ষা, অজ্ঞতা হাওর জনপদে বন্ধুর মতো জড়িয়ে আছে। ফলে তাদের ভেতর স্বাস্থ্য সচেতনতা শূন্যের কোঠায়। নেত্রকোনার খালি হাওর অঞ্চলে ৩৫ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করে। এখনো ৬৫ শতাংশ পরিবার ঝুলন্ত বা কাঁচা পায়খানা ব্যবহার করে। অনেকেই ঝোপঝাড়ের আড়ালে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পন্ন করে। স্যানিটেশন বিজ্ঞানসম্মত না হওয়ায় দূষিত হচ্ছে পানি। হাওর জনপদে লেগেই আছে পানিবাহিত রোগ। পানিবাহিত কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয়, কৃমি ও জন্ডিসের মতো রোগবালাই সারা বছরই দেখা যায় হাওরের কোনো না কোনো ঘরে। সঠিক চিকিত্সার অভাবে হাওর অঞ্চলে শিশু মৃত্যুর হার দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক বেশি। হাওর এলাকায় ডাক্তার সহজলভ্য নয়। উপজেলা হাসপাতালগুলোয় ডাক্তারের পোস্ট শূন্য পড়ে থাকে। সেসব এলাকায় যেতে চায় না কেউ।
হাওরে বসবাসরত মানুষজন প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বেঁচে আছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন হাওরের বেশিরভাগ ঘর-বাড়ি ভেঙে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ‘এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ হাওর অঞ্চলে পানির উচ্চতা প্রাক্বর্ষা মৌসুমে দশমিক ৩ থেকে দশমিক ৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং সময় থাকতেই হাওরে আনতে হবে পরিকল্পিত কর্মসূচি, যে কর্মসূচি হবে উন্নত পৃথিবীর পানিবেষ্টিত জনপদের মতো জীবনবান্ধব।
বাল্যবিয়ে হাওরের ঘরে ঘরে যেন এক সামাজিক রোগ। যে মেয়েটির খেলার বয়স, স্কুলে বইখাতা নিয়ে পড়ালেখা করার বয়স এবং ক্রমে ক্রমে দীঘল চুলে বেণি বোনার মতো স্বপ্ন বোনার বয়স, সে বয়সেই হাওরের সিংহভাগ মেয়ের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে। অল্প বয়সেই মা হয়ে তারা ভুগছে নানা রোগব্যাধিতে। যে সন্তান তার কোলে সেও অপুষ্টিতে আক্রান্ত। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইন নয়, মূলত শিক্ষার আলোই ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। অতএব, হাওরের শিক্ষাব্যবস্থা যে করেই হোক সম্প্রসারিত করতে হবে। হতাশার হাহাকার থেকে হাওরকে অবশ্যই বের করে আনতে হবে।
‘মাছে ভাতে বাঙালি’ আজন্ম কালের প্রবাদ। দেশের মত্স্য সম্পদের একটি বড় অংশ হাওরেই উত্পাদিত। দেশের মোট মাছের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ জোগান দেয় হাওর। দেড় কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা মত্স্যসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। ১৩ লাখ মানুষ সরাসরি মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। রফতানি খাতের মধ্যে মত্স্য অন্যতম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বেলায় মত্স্য খাত দ্বিতীয়।
হাওর বিশ্লেষকরা বলছেন, হাওর হলো গ্ৰামীণ আদি ফিসারি। এই ফিসারিতে মিঠা পানির মাছ আছে ১৫০ প্রজাতির। আছে ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ। হাওরের একশ্রেণির মানুষ মাছ,পানিফল ও শামুক সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে বাস্তবতা হলো এই সকল পানিপণ্য তারা পানির দরে বিক্রি করে। কারণ, এই মূল্যবান রত্নের যথাযথ বাজার তাদের নাগালের বাইরে। সরকার উদ্যোগ নিলে ঝিনুক ও শামুক থেকে মুক্তা সংগ্রহের পথ প্রশস্ত হতে পারে। বিশ্ববাজারে এই মুক্তা রপ্তানি করে সম্ভব হতে পারে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। পাশাপাশি মুক্তা সংগ্রহকারীদের জীবনে আসতে পারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুপালন করে হাওরের দরিদ্র মানুষ জীবিকার পথ ধরে আছে। সরকার এই খাত সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিলে হাওরে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সিংহ দুয়ার খুলে যাবে। কৃষি বিন্যাস, ফার্মিং সিস্টেম প্রযুক্তি-নির্ভর করলে হাওরে উৎপাদন পণ্য থেকে কৃষক ও সরকার দুপক্ষই লাভবান হবে। হাওরে আছে সুদের ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। এদেরকেও প্রতিরোধ করতে হবে। প্রয়োজনে এদেরকে আনতে হবে আইনের আওতায়। তাহলে বাঁচবে কৃষক, হাসবে কৃষি।
শীতের প্রারম্ভ থেকে হাওরে আসতে থাকে অতিথি পাখি। প্রতি বছর শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমনে পুরো শীতকাল হাওর অঞ্চলে বিরাজ করে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। ভূ-প্রকৃতিগত বৈচিত্র্যের কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে সন্দেহ নেই এ দেশের হাওর অঞ্চল একটি অন্যতম জনপদ।
বর্তমান জনবান্ধব সরকার দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের সফল উদ্যোগে হাওর হতে পারে পর্যটন পিয়াসীদের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। অর্জন হতে পারে এ শিল্প থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন হাওরে নেওয়া যেতে পারে মহাপরিকল্পনা। পানি সহনশীল করৈ,হিজল গাছ রোপণ করে গ্ৰামগুলোকে ঢেউয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। বর্ষাকালীন প্লাবন পানিতে বাঁধ দিয়ে কোটি কোটি টাকার অস্থায়ী ফিসারি করে আমিষের চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। এতে এলাকায় অসংখ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব দূর হবে। বিভিন্ন এলাকায় মাছ সরবরাহ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। সরকার হয়তো জরিপ করে এসব মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করবেন এলাকার সচেতন মহলের দাবি।
বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব নেত্রকোনা জেলা শাখার সভাপতি শামীম আহমেদ তালুকদার জানান, জেলার হাওর অঞ্চলে সরকারিভাবে বন, মাছ নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্ৰহণের স্থান ও সুযোগ দুটোই আছে।এত এসব এলাকার অভাবনীয় সাফল্য আসবে।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘এরইমধ্যে নেত্রকোনা জেলার হাওর অঞ্চলে অনেক ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।কূষি নিয়ে ও গবেষণা চলছে। বন্যাকালীন সহযোগিতা করা হয়। অদূর ভবিষ্যতে হাওর অঞ্চল নিয়ে আরও গবেষণা হবে। তখন হয়ত হাওর অঞ্চল অনগ্ৰসর থাকবে না।’
সারাবাংলা/একে