কয়লা সংকটে ধুঁকছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, ২য় ইউনিট চালু নিয়ে সংশয়
২৯ মে ২০২৩ ০৮:৫০
ঢাকা: গেল বছরের ১৭ ডিসেম্বর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একাংশ চালুর পর থেকেই যেন সংকট পিছু ছাড়ছে না। শুরুতে যান্ত্রিক ত্রুটিতে কিছুদিন বন্ধ রাখা হয় কেন্দ্রটি। এরপর শুরু হয় কয়লা সংকট। যে কারণে গত পাঁচ মাসে একাধিকবার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা ডলার। ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না। যে কারণে আসছে জুন মাসে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে দ্বিতীয় ইউনিট চালুর কথা রয়েছে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে।
দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সাপমারি-কাটাখালীও কৈর্গদাশকাঠী এলাকায় ১ হাজার ৮৩৪ একর জমির ওপরে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি। রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের সিদ্ধান্ত হয় ২০১০ সালে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের এনটিসিপি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২০১৩ সালে এর ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহ্বান করে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় ২০১৬ সালে। ইকুইটি বিনিয়োগ সমান ভাগে ধরে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট রামপাল বাস্তবায়নে গঠন করা হয় বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি ইউনিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৭ সালে। কাজ শুরুর তারিখ থেকে ৪১ মাসের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়া, কয়লা আমদানিতে বিলম্বসহ করোনাভাইরাসের কারণে তা শেষ করতে লেগে যায় প্রায় চার বছর।
এরপর গেল বছরের ডিসেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে একটি ইউনিটের উৎপাদন শুরু করে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু উদ্বোধনের ২৭ দিনের মাথায় কয়লা সংকটে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয় সরকারের এই অগ্রাধিকারমূলক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর গত পাঁচ মাসে মোট তিন দফায় বন্ধ হয়েছে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের উৎপাদন।
জানা যায়, রিজার্ভ কয়লা দিয়ে কয়েকদিন চালু রাখার পর প্রথম বন্ধ হয় গত ১৪ জানুয়ারি। কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক করে কেন্দ্রটি চালু করার দুই মাস পর ১৫ এপ্রিল যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। তিন দিনের মাথায় ফের চালু করা হলেও ৫ দিন পর আবার বন্ধ করা হয়। এরপর সবশেষ গত ২৩ এপ্রিল তৃতীয়বারের মতো কয়লা সংকটে বন্ধ রাখা হয় কেন্দ্রটি। যার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট পূর্ণ মাত্রায় অর্থাৎ ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লার দরকার। কিন্তু অধিকাংশ সময় ইউনিটটি সক্ষমতার কম-বেশি উৎপাদন করেছে। প্রথম ইউনিট ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও সর্বোচ্চ উৎপাদন করছে ৫৬০ থেকে ৫৭০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৪৬০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে এবং ২০০ মেগাওয়াট খুলনা-বাগেরহাটে সরবরাহ করা হয়। যা চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট নয়।
বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, পিক আওয়ারে ৯৪ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৫৫ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে, অফপিকে ৮০ থেকে ৮২ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ আসছে ৪৫ থেকে ৫০ মেগাওয়াট।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রধান সমস্যা ডলার। ডলারের দাম অস্বাভাবিক বাড়তি থাকায় ঋণপত্র খোলার অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে কয়লা আমদানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না। যে কারণে বারবার বন্ধ করতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন।
এদিকে, আগামী জুন মাসে রামপালের ৬৬০ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় ইউনিট চালুর কথা রয়েছে। এই ইউনিট চালু হলে প্রতিদিন ১০ হাজার মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন হবে। বিশ্ববাজারে ডলারের এই পরিস্থিতি থাকলে এই পরিমান কয়লার যোগান দেওয়া কোনোভাবে সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপ-মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা এসেছে, আরও ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা বাংলাদেশের পথে রয়েছে। আগের ক্রয় আদেশ অনুযায়ী মোট ১ লাখ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে। মূলত সংকট সৃষ্টি করছে ডলারের মূল্য। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে যাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।’
সারাবাংলা/জেআর/এমও