Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে ‘ধর্মীয় বক্তা’ বানানো ইসকপ কার্যালয় উচ্ছেদ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩০ মে ২০২৩ ২১:২৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আশির দশকে বিতর্কিত মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ধর্মীয় বক্তা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পাইয়ে দেওয়া ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের (ইসকপ) কার্যালয় উচ্ছেদ করেছে জেলা প্রশাসন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকারি জমি দখলে রেখে সংগঠনটি দীর্ঘসময় ধরে অবৈধভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। সামাজিক সংগঠনের আড়ালে জামায়াত-শিবির এ কার্যালয়কে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।

মঙ্গলবার (২৯ মে) দুপুরে নগরীর চকবাজারে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ছাত্রাবাস সংলগ্ন ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের কার্যালয় উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত।

জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ নামে সংগঠনটি শহরের চকবাজারে কাসিমপুর মৌজায় অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত ৫ দশমিক ৪০ শতক জমি ইজারা পায়। পরবর্তী সময়ে তারা আশপাশের আরও সরকারি জমি দখলে নিয়ে দোতলা ভবন গড়ে তোলে। সেখানে সংগঠনের কার্যক্রমের পাশাপাশি একই ধারার বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকেও ভাড়া দেওয়া হয়েছিল।

৫০ বছর ধরে তারা নিয়মিত খাজনা পরিশোধের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া জমি দখলে রেখেছিল। একইসঙ্গে অবৈধভাবে দখল করা জমিতেও তারা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে তারা আর ইজারা নবায়ন করেনি। এরপর থেকে তারা অবৈধভাবে পুরো জায়গাটি দখলে রেখে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল বলে জানান এনডিসি।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘দোতলা ভবনে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের কার্যালয়ের পাশাপাশি দারুশ শেফা, হজ কাফেলাসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়। তবে সেগুলো তালাবদ্ধ দেখা যায়। আমরা জানতে পেরেছি, ২০২০ সাল পর্যন্ত সেখানে সমাজকল্যাণ পরিষদের কার্যক্রম নিয়মিত ছিল। পরে অনিয়মিত হলেও তারা দখল বজায় রেখেছিল। আমরা অভিযান চালিয়ে সব কার্যালয় থেকে মালামাল জব্দ করে সেখানে জেলা প্রশাসনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিই। ভবনটি সিলগালা করা হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, অভিযানে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের কার্যালয় থেকে মতিউর রহমান নিজামীসহ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে লেখা বিভিন্ন বিতর্কিত বই, জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক নথিপত্র, প্রকাশনা, সংগঠনের ব্যানার উদ্ধার করা হয়েছে।

জানা গেছে, পাকিস্তান আমলে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের শুরু হওয়া কার্যক্রম দেশ স্বাধীনের পর স্থিমিত হয়ে যায়। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জামায়াত ইসলামী প্রকাশ্য রাজনীতির অনুমতি পেলে সংগঠনটিও পুনরুজ্জীবীত হয়। ১৯৭৭ সালে জামায়াত ঘরানার কয়েকজন ব্যক্তি চট্টগ্রামে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদকে (ইসকপ) আবার চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেন।

এর অংশ হিসেবে ১৯৭৭ সালে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে প্রথম তাফসিরুল কুরআন মাহফিলের আয়োজন করে। পরের বছর কলেজিয়েট স্কুলের ‍মাঠে মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এরপর লালদিঘী মাঠে এবং পরবর্তী সময়ে জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত চকবাজারের প্যারেড কর্নারে পাঁচ দিনব্যাপী তাফসিরুল কুরআন মাহফিল আয়োজন করা হতো।

টানা ৩০ বছর ধরে তাফসিরুল কুরআন মাহফিলে বয়ান দেন দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত সাঈদীর বয়ান অব্যাহত ছিল। এই মাহফিলের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সাঈদীর নাম, ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের পরিচিতিও।

আশির দশকের শুরুতেই ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন নেতাকে খুনের মধ্য দিয়ে চকবাজারে চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ দখলে নিয়েছিল ছাত্রশিবির। তিন দশক পর ২০১৭ সালে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে শিবিরকে হটিয়ে দুই কলেজে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সেদিন ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। ওই সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অদূরে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের কার্যালয় ভাংচুর করেছিল।

চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসীন কলেজকে শিবিরমুক্ত করতে নেতৃত্ব দেওয়া নগর ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ ছিল জামায়াত ইসলামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ভাবাদর্শের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা তাফসিরুল কুরআন মাহফিলের নামে সাইদীকে প্রধান অতিথি করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসতো। সাঈদীর বয়ানের অধিকাংশ জুড়ে থাকত মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা। জাতির পিতা, জননেত্রী শেখ হাসিনা, শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে নিয়ে উসকানিমূলক নানা বক্তব্য দিতেন। ধর্মান্ধতা, উগ্র মৌলবাদ ছড়াতেন। আমরা এই সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছি।’

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৭ সালের ২১ আগস্ট আমরা দুই কলেজের ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের কার্যালয় উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছিলাম। এরপর আমরা ওই দাবিতে নিয়মিত মিছিল-সমাবেশ করেছি। এই কার্যালয়তে জামায়াত-শিবির তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করত। ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা করে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নিত শিবির ক্যাডাররা। জেলা প্রশাসন শেষ পর্যন্ত কার্যালয়টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ায় আমরা স্বস্তিবোধ করছি।’

সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক মায়মুন উদ্দীন মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা মূলত জামায়াতি মতাদর্শ প্রচার করে যাচ্ছে। সমাজকল্যাণের নামে তারা যাকাত, ফিতরা, কোরবানির পশুর চামড়া, দান, ছদকার টাকা গ্রহণ করে এবং জামায়াতের তহবিলে দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করে বলে অভিযোগ আছে। জামায়াত-শিবির এ কার্যালয়কে তাদের গোপন সাংগঠনিক আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করতো। করোনাকালীন সময়ে তারা এখানে অনলাইন মিটিং করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা এসব বিষয় তদন্ত করে আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

ইসকপ উচ্ছেদ কার্যালয় জামায়াত সাঈদী


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর