Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর ডলার সঙ্কট মোকাবিলায় আসছে বিশাল বাজেট

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ জুন ২০২৩ ১১:২৪

ঢাকা: রাজস্ব আহরণের উচ্চভিলাসী লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিকেলে জাতীয় সংসদে পেশ হচ্ছে বিশাল ঘাটতির বড় বাজেট। ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ শিরোনামে এবারের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা, আমদানি বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে রফতানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নানামুখী চাপ সামলনোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এবারের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত এটি হবে তার পঞ্চম বাজেট, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম, বর্তমান সরকারের টানা ১৫তম বাজেট।

বিজ্ঞাপন

অর্থবিভাগের সর্বশেষ বাজেট প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ডলার সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই ঋণ পেতে আইএমএফ‘র বেশ কিছু কঠিন শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। আর এতে বাড়াতে হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। পাশাপাশি ব্যাংক, আর্থিক ও রাজস্ব খাত সস্কারসহ সরকারকে কয়েকটি শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। এই শর্তের আলোকে প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে করদাতা বাড়াতে হবে। ফলে একদিকে করের আওতায় বাড়ানো পাশাপাশি জনগণকে সামাজিক সুরক্ষা খাতে নিরাপত্তা দেয়ার বহুমুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ বাজেট উপস্থাপন করা হচ্ছে।

বাজেটের অঙ্ক: অর্থমন্ত্রী আজ ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আর সংশোতি বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এবারের বাজেটের মোট আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

সংকট সত্ত্বেও উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য: আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত জিডিপির চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ রয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বৈশ্বিক সংকটেও এ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করছে সরকার। যদিও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীরা বলছে, বৈশ্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগের তুলনায় হ্রাস পাবে।

মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ধরে রাখার চেষ্টা: টানা প্রায় দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে; যা এখন প্রায় ২ অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই। মূল্যস্ফীতির এ চাপকে ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে আগামী বাজেটে। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাজেটে ঋণ পরিশোধ করতে হবে: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদ ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৮২ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। চলতি বাজেটে এর আকার ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।

আইএমএফ‘র শর্ত পূরণে অতিরিক্ত ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে: আইএমএফে‘র ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পেতে হলে ৩৮ রকমের শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। আগামী বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। এনবিআর হিসাব করে দেখেছে এই বাড়তি করের পরিমাণ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। ফলে বিভিন্ন খাতে করছাড় কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন নতুন খাতে কর বসিয়ে বাড়তি এই রাজস্ব আদায়ে করতে হবে।

আকাশ, স্থল ও জলপথে ভ্রমণ কর বাড়ছে: আসছে বাজেটে আকাশ, স্থল ও জলপথে ভ্রমণ কর ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পর‌্যন্ত বাড়ছে। আর এইক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ১ হাজার ২০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা দিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ভ্রমণ কর ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হতে পারে। এতে প্রবাসী শ্রমিকদের খরচ বাড়বে।

আয় না থাকলেও নূন্যতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে: আসছে বাজেটে রাজস্ব আয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাপকভাবে করহার বাড়ানো হচ্ছে। সে সঙ্গে ধনীদের করের স্লাব কিছুটা বাড়িয়ে নিম্নআয়ের মানুষকে করজালের আওতায় আনা হচ্ছে। এইক্ষেত্রে করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয় দেখিয়ে আগে রিটার্ন জমা দেওয়া গেলেও এবার তা হচ্ছে না। আগামী বাজেটে রিটার্ন জমা দিয়ে স্লিপ পেতে হলে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে সঞ্চয়পত্র কেনা, ব্যাংক ঋণ নেওয়া, ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, বাড়ির নকশা অনুমোদনসহ সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না।

বাজেটে বাড়ছে করমুক্ত আয় সীমা: আসছে বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে। তিন বছর পর করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ কিছুটা করের জাল থেকে রক্ষা পাবে। তবে বাজেটে বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে গরিবের কষ্ট বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হলেও ধনীদের জন্য থাকছে বিশেষ কর ছাড়। এ ছাড়া ব্যাংকে যার যত বেশি টাকা থাকবে সে তত বেশি ছাড় পাবে।

যেসব জিনিসের দাম বাড়তে পারে: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে আসছে বাজেটে বেশ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্লট, ফ্ল্যাট, গাড়ি বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র, টয়লেট টিস্যু, কলম, মোবাইল ফোন, কলমসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরনের দাম বাড়বে পারে বলে জানা গেছে। এছাড়াও বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী, অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী ও হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন,কিচেন টাওয়াল,টয়লেট টিসু,ন্যাপকিন টিসু, ফেসিয়াল টিসু/পকেট টিসু ও পেপার টাওয়াল, কাজুবাদাম, খেজুর, বিভিন্ন ধরনের বিদেশী জুসের দাম বাড়বে, সিলিন্ডার গ্যাস, আমদানিকৃত বাসমতি চাল, সব ধরনের সিগারেট, জর্দা-গুলের দাম বাড়বে। তবে বিড়ির দাম অপরিবর্তিত থাকবে। এছাড়াও চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস সাইকেলের যন্ত্রাংশ, সিরিশ কাগজ, বিভিন্ন ধরনের আঠা বা গ্লু, সিমেন্ট, বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিদেশি টাইলসের দাম বাড়তে পারে।

বাজেটের আয় যেভাবে আসবে: আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর কর ছাড়া আয় ৫০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআরে কর বহির্ভূত আয় ২০ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান থেকে আয় ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

বাজেটে যেভাবে ঘাটতি পূরণ করা হবে: আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক অনুদান বাদে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ লাখ ৮৮৫ কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেট পূরণের সরকার অভ্যান্তরীণ ঋৎস ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বিদেশ থেকে ঋণ নিচ্ছে ১ লাখ ২ হাজার হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

অভ্যান্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নেয়া হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অনান্য খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ও ব্যায়ের খাত: আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপি’র আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। পরিচলন ব্যয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। খাদ্য হিসাবে ব্যয় ৫০২ কোটি টাকা এবং ঋণ অগ্রিম বাবত ব্যয় ৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা।

সারাবাংলা/জিএস/এনইউ

বাজেট ২০২৩-২৪

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর