Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আদর্শ শহরের অর্ধেকও গাছ নেই ঢাকায়, জলাভূমিও ৭১ শতাংশ কম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৩ জুন ২০২৩ ১৯:৩০

ঢাকা: আদর্শ শহরের মান অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় সবুজভূমি থাকার কথা ১৫ শতাংশ। সেখানে আছে মাত্র ৭ শতাংশ সবুজভূমি। অন্যদিকে জলাভূমি থাকার কথা ১০.১২ শতাংশ, সেখানে আছে ২.৯ শতাংশ জলাভূমি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় সবুজ ভূমি রয়েছে অর্ধেকেরও কম, জলাভূমি রয়েছে আদর্শ শহরের মান অনুযায়ী ৭১ শতাংশ কম।

১৯৯৫ সালে রাজধানীর ১৪৭ বর্গকিলোমিটারের কেন্দ্রীয় নগর অঞ্চলে জলাধার ও জলাভূমি ছিল ৩০ দশমিক ২৪ শতাংশ। যা ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে বর্তমানে আছে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর সবুজ ও ফাঁকা জায়গা ৫২ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর এক গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

শনিবার (৩ জুন) ২৮ বছরে রাজধানীর ‘জলাধার ভরাট এবং সবুজ নিধন: বাস্তবতা এবং উত্তরণের পথনকশা’ শিরোনামের এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। আয়োজনে বিআইপি এবং সহযোগিতায় নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম।

গবেষণায় পর্যায়ক্রমিক হ্রাস নির্ধারণে ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান প্রেক্ষাপট, বর্তমান প্রেক্ষাপটের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানে গুগল ছবি, কেইস স্টাডি এবং সেকেন্ডারি লিটারেচার পর্যালোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি সমাধানে করণীয় বিষয়ে পরামর্শও উঠে এসেছে।

২৮ বছরে রাজধানীর সবুজভূমির ক্রমবর্ধমান হ্রাসের কারণ হিসেবে দেখা গেছে পার্কের উন্নয়ন প্রকল্পে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেশি থাকা, খেলার মাঠ দখল করে ক্লাব, মার্কেট, হাটবাজার ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ। আর জলাধার কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে রাজধানীর অধিকাংশ জমির মালিকানা ব্যক্তিগত হওয়ায় নির্দিষ্ট ভূমি অঞ্চল সংরক্ষণের জন্য অনুমোদিত নির্দেশিকা থাকা সত্বেও তা মেনে চলা হয় না, ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নের জন্য জলাভূমি ভরাট করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি।

সমাধান হিসেবে তারা বলেন, ড্যাপে বর্ণিত ‘নগর জীবনরেখা’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নগরের সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে, শহরের জলাধার ও সবুজ এলাকা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে জলাধার সংলগ্ন জায়গায় পাবলিক স্পেস তৈরি করতে হবে এবং ঢাকা কেন্দ্রিক উন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করে অবশিষ্ট সবুজভূমি রক্ষা করতে হবে।

আর জলাধার রক্ষায়, ড্যাপে বর্ণিত টিডিআর পিলিসির বাস্তবায়ন করতে হবে, জলাধার ও জলাশয়কে সামনে রেখে উন্নয়ন করতে হবে, এবং ঢাকা কেন্দ্রিক উন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

বিআইপি সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমনের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এর মাননীয় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান।

তিনি বলেন, বসবাসযোগ্যতার তালিকায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিক থেকে সপ্তম। শহরের সবুজ নিধন ও জলাধার ভরাটের পছনে রয়েছে সচেতনতার অভাব, আইনি কাঠামোর দুর্বলতা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহার। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এরইমধ্যে খাল পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে যা প্রশংসনীয় হলেও ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস ও নগর জীবনরেখা, রিভার মাস্টার প্ল্যান ও সবুজভূমি রক্ষার্থে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ অনুযায়ী সুষম নগরায়নের বাস্তবায়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়ন করতে হবে।

আলোচনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সঠিক পরিকল্পনার ব্যর্থতা আমাদের ভবিষ্যতকে ব্যর্থতার দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে স্পষ্টত জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের কথা বলা আছে তাই সর্বপ্রথম আমাদের দেশের বাস্তবতার আলোকে জলাধার, সবুজ এলাকাসহ নগর পরিকল্পনা ও পরিবেশগত সকল নির্দেশকের মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল বিআইপি’র গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘জলাধার সবুজ নিধন ও সংরক্ষণ বিষয়টি শুধুমাত্র টেকনিকাল, সাংস্কৃতিক নয়, রাজনৈতিকও। এ দায়িত্ব আমাদের সবার হলেও মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পালন করতে হবে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদ ডীন ড. ইশরাত ইসলাম ঢাকা শহরের জলাধার ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘সবুজ ভূমি এবং জলাভূমির সঠিক সঙ্গায়ন প্রয়োজন। কারণ ছাদবাগানের জন্য স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে সবুজায়নের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা। অপরদিকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে জলাধার ভরাট করে উন্নয়ন করার জন্য রাজউক থেকে অনুমোদন নেয়া হয়, কিন্তু এখানে উল্লেখ্য যে, রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং কখনো জলাধার ভরাটের সমাধান হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ড্যাপ অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত পুর্বাচল থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রাইভেট ডেভেলপারদের যত প্রকল্প আছে তা প্লটভিত্তিক, যার ফলে পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের সুফল থেকে ঢাকা বঞ্চিত হবে। এ ছাড়াও ড্যাপে যে ৫৫ টা জলকেন্দ্রিক পার্কের কথা বলেছে তার বেশিরভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন তা বাস্তবায়নে ব্যক্তিমালিককে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। ২০১৬ সালের খালের নেটওয়ার্ক ম্যাপ এবং ব্লু নেটওয়ার্ক ম্যাপ প্রতিস্থাপিত করলে দেখা যায়, অনেক খাল এই ব্লু-নেটওয়ার্ক থেকে বাদ পড়েছে। এছাড়াও অনেক খাল বা জলাধার দখল হয়ে গিয়েছে। এই সব খাল আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়াটা আমাদের দ্বায়িত্ব, তাই এই নেটওয়ার্ক রক্ষা করতে অনতিবিলম্বে এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী কাজ করা প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান বলেন, পূর্বাচলের পরিকল্পনার ৪ নং সংশোধিত পরিকল্পনায় যে ১৯% বনভুমি সংরক্ষণের কথা বলেছে, তা পর্যায়ক্রমে রাতের আধারে ধীরে ধীরে পুড়িয়ে উজাড় করা হয়েছে। একটি মানুষের টেকসই জীবনযাত্রার জন্য শুধুমাত্র বসবাসের স্থানই যথেষ্ট নয় বরং জলাভূমি ও সবুজভূমির ও প্রয়োজন রয়েছে এপ্রেক্ষিতে ঢাকার এতো জনসংখ্যা ধারণের ক্ষমতা নেই।

এছাড়া তিনি সুনির্দিষ্ট তিনটি দাবি উপস্থাপন করেন (বিএডিসি কর্তৃক প্লাবনভূমি ভরাট, হাতিরঝিলে মাটি ভরাট এবং গেণ্ডারিয়ায় দিঘি ভরাট) এবং তা সমাধানের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানান।

স্ট্যামর্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডীন ও সভাপতি অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘ঢাকার বায়ুমান ও তাপমাত্রা বিদ্যমান সবুজভূমি ও জলাধারের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ঢাকায় সবুজভূমি ও জলাধারের তুলনায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার তাপমাত্রা স্থানভেদে ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এজন্য গাছ যদি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাড়ায় তাহলে তা নিধন না করে স্থানান্তর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।’

নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি অমিতোষ পাল বলেন, ‘নগর পরিকল্পনাবিদদের মোতাবেকে একটি পার্কে ৫% এর অধিক কনক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা থাকা যাবে না, কিন্তু গুলশানের সাহাবউদ্দিন পার্ক, ওসমানী উদ্যান এর বর্তমান অবস্থা এবং উন্নয়নের নামে সেখানকার জলাধারের সংকোচন ভিন্ন চিত্র প্রদান করছে। নগরের জলজীবন ও সবুজায়ন রক্ষার্থে দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। এছাড়াও পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক কর্মব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে যেখানে, পরিকল্পনাবিদদের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই যা টেকসই নগর তথা দেশ গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে বি.আই.পি-র প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকাকে টেকসই ও বাসযোগ্য করার জন্য ১৪৭ বর্গমিটারের ঢাকার কেন্দ্রীয় নগর অঞ্চলের বাইরে যে বর্ধিঞ্চু এলাকা রয়েছে, সেখানে বিদ্যমান পার্ক বা খেলার মাঠ ও জলাভূমিসমূহ ল্যান্ড ব্যাংকিং এর দখল হওয়ার পূর্বেই সিল করতে হবে।

প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রতিনিধি, সোসাইটি অব এক্সপার্টস অন এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট (সীড) সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই) সহ সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকী, নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম সভাপতি অমিতোষ পাল, সাধারণ সম্পাদক মো. সোহেল মামুনসহ আরও অনেকেই।

সারাবাংলা/আরএফ/একে

টপ নিউজ রাজধানী ঢাকা শহর


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর