প্লাস্টিক পোড়ানোয় বাড়ছে বায়ুদূষণ, থামাতে চাই জরুরি উদ্যোগ
৪ জুন ২০২৩ ২০:৩৭
ঢাকা: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বাড়ছে বায়ুদূষণ। যার প্রভাব পড়ছে প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশের উপর। ‘প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের পরিবেশগত এবং আইনগত প্রেক্ষাপট’ বিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে।
রোববার (৪ জুন) স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ও বারসিক’র যৌথ আয়োজনে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহ-আয়োজক হিসেবে ছিল পরিবেশ উদ্যোগ, বাংলাদেশ ন্যাচার কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (বিএনসিএ) ও সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)। গোলটেবিল বৈঠকের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ও অতিথিদের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ রোধে একটি মানববন্ধন করা হয়।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান। তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণ বাড়ছে। দূষিত বায়ু জীববৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মাটি ও জলাধারগুলোতে জমে থাকা বিষাক্ত প্লাস্টিক খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করছে এবং বিভিন্ন স্তরের জীবের খাদ্যচক্রে মিশে যাচ্ছে। তাই উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। এর সঙ্গে উন্মুক্ত পরিবেশে প্লাস্টিক পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, এমপি বলেন, ‘প্লাস্টিক আমাদের দেশের সুন্দর পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। প্লাস্টিক একাধারে মাটি, পানি ও সমুদ্র দূষিত করছে। প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বাতাসও দূষিত হচ্ছে, তাই এখন আর আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য নির্মল বাতাস পাই না। শুধু সরকার একা কাজ করে এই দূষণ কমাতে পারবে না। ব্যক্তি পর্যায়ে প্লাস্টিক রিসাইকেল সম্ভব না হলেও আমরা চাইলে প্লাস্টিক রিফিউজ এবং রিইউজ করতে পারি।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন বলেন, ‘প্লাস্টিক আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাইলেই খুব সহজে এর ব্যবহার বন্ধ করে দিতে পারব না। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের আগে এর বিকল্প উদ্ভাবন করতে হবে এবং সবাইকে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘প্লাস্টিক বন্ধে সকল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার। প্লাস্টিক রোধে পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশে পাটের ব্যাগ উদ্ভাবন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাবে এর প্রচার-প্রসার হয়নি। প্লাস্টিক দূষণরোধে আমাদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে এবং পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি মানুষের বোঝার মতো ভাষায় কথা বলতে হবে।’
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বলেন, ‘ঢাকা শহরের মোট বর্জ্যের শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগই প্লাস্টিক। ফলে যেখানেই বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে সেখানে প্লাস্টিকও পোড়ানো হচ্ছে, যা বায়ু দূষণ বাড়াচ্ছে। আবার প্লাস্টিকের পুড়ে যাওয়া অংশগুলো মাটি ও পানিতে মিশে মাটির উর্বরতা ও পানির গুণগতমান নষ্ট করে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে বায়োডিগ্রেডেবল কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে যেসব ক্ষতিকর গ্যাস এবং রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে অবমুক্ত হয় প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণেও একই রাসায়নিক পদার্থ অবমুক্ত হয়।’
বিএনসিএ-এর সদ্যস সচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘প্লাস্টিক দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের মাছ কমে গেছে। বিএফডিসি এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে সমুদ্রে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ শনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ফেসিয়ালিস ঘাটে ১৮ থেকে ২০ প্রজাতির বেশি মাছ দেখা যায় না । স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বাঁচতে হলে বিদ্যমান পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন জরুরি।’
সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি এফেয়ার (সিএলপিএ)-এর সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, ‘পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে প্লাস্টিক ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।’
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামিম আহমেদ বলেন, ‘প্লাস্টিক নিয়ে আমাদের সচেতনতা কম। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক সচেতন। আমাদের উচিত নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়া।’
গোলটেবিল বৈঠকে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলায় বেশ কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-
১. পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা (বায়োডিগ্রেডেবল) ব্যবহার করা, এগুলো সহজলভ্য করা এবং এসব ব্যাগ ও ঠোঙা ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
২. পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন প্রচলন করা।
৩. পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর পলিথিন ও প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যেন বিদ্যালয় থেকেই শিশুরা সচেতন হতে পারে।
৪. পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল আমদানি বন্ধে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানিকৃত পলি-প্রপাইলিন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬. উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে।
৭. উন্মুক্ত পরিবেশে প্লাস্টিক পোড়ানো বন্ধ করতে হবে এবং এই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৮. পরিবেশ অধিদফতর, পাট অধিদফতর, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
গোলটেবিল অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন- স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইউনুস মিয়া, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) এর প্রধান সমন্বয়কারী মো. শামসুদ্দোহা, রিভার ও ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, নিরাপদ ডেভলপমেন্ট বাংলাদেশ নির্বাহী পরিচালক ইবনুল সাইদ রানা, পরিবেশ উদ্যোগের সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার মো. নাসির আহমেদ পাটোয়ারী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, সিজিইডি’র নির্বাহী পরিচালক আব্দুল ওহাব, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ’র অ্যাডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন কোঅর্ডিনেটর মীর রেজাউল করিম, নোঙ্গরের সভাপতি সুমন সামস, বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এম শাফিউর রহমান এবং এইচআর শিপ ম্যানেজমেন্টের সিইও মো. মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।
সারাবাংলা/আরএফ/পিটিএম