একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকেই বাড়ছে দূষণ
৬ জুন ২০২৩ ০৯:১৫
ঢাকা: চশমা থেকে স্ট্র, গামলা থেকে ঝাড়ু- প্রতিদিনের জীবনে প্লাস্টিক পণ্যের নানাবিধ ব্যবহার বেড়েই চলেছে। সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ার জন্য প্লাস্টিকপণ্যের জনপ্রিয়তাও বেশি। শুধু খাবারের প্যাকেট বা পানির বোতলই নয়, বর্তমানে আধুনিক জীবনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস, চামচ, চায়ের কাপ ইত্যাদি। এমনকি মাটির ব্যাংকের জায়গাও দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়লেও এটি রিসাইকেল ও রি-ইউজের পরিমাণ না বাড়ায় এসব প্লাস্টিকের অধিকাংশই সরাসরি চলে যাচ্ছে পরিবেশে। বাড়াচ্ছে মাটি ও পানি দূষণ।
এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ জলাভূমি, কৃষিভূমিসহ সাগরের সম্পদ সবই হারাবে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক দূষণ দূর করতে না পারলে ২০৫০ এর মধ্যে সাগরে কোনো মৎস্য সম্পদ থাকবে না।
এমনই বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপি ‘প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে, সামিল হই সকলে’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে পালিত হয়েছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৩। এবার দিবসের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ।’
দেশে ২০০২ সালে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) অনুযায়ী ‘সব প্রকার প্লাস্টিক শপিং ব্যাগের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ ও বিতরণসহ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ’। এই আইন থাকার পরেও সব জায়গায় প্লাস্টিকের অবাধ বিচরণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লাস্টিক দূষণ রোধে সরকারের কোনো রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা না থাকা ও সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই নিষিদ্ধ পলিথিনের বাজার এত রমরমা।
পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমেদ কামররুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের চেয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা বেশি জরুরি। প্লাস্টিক দিয়ে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গৃহস্থালী নানা পণ্য তৈরি হচ্ছে যা দশ থেকে বিশ বছর ধরে ব্যবহার করা যায়। এগুলো সমস্যা না, সমস্যা যে জিনিসগুলি আমরা ঘণ্টাখানিক ব্যবহার করে পরিবেশে ছেড়ে দিচ্ছি। এটিকে দুস্প্রাপ্য করতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প খোঁজার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে, প্লাস্টিক নিজেই বিকল্প হিসেবে এসেছিল। কাঁচের জিনিসের বিকল্প হিসেবে এসেছিল প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের মতো সহজলভ্য করে পরিবেশবান্ধব কোনো জিনিস আনলে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে যাবে।’
এদিকে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে আমাদের অবস্থান নিচের দিকে থাকলেও আমাদের প্রধান ঘাটতি প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনায়। আমরা রি-ইউজ (পুনঃব্যবহার) ও রিসাইক্লিংয়ে (পরিবর্তিত ব্যবহার) গুরুত্ব দেই না। কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘প্লাস্টিক ব্যবহারের চেয়ে প্লাস্টিকের মিসম্যানেজমেন্ট আমাদের বেশি ক্ষতি করছে। শুধুমাত্র ঢাকার দুই সিটিতে প্রতিদিন ৬ হাজার ৮০০ মেট্রিকটন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র অর্ধেক আমরা ভাগাড়ে নিতে পারলেও বাকি সাড়ে তিন হাজার এদিকে-সেদিকে পড়ে থাকছে। এভাবে প্লাস্টিক নদীতে মিশে যাচ্ছে।’
সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক কীভাবে জলাশয় দূষণ করছে জানতে চাইলে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়রাম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘যতটুকু প্লাস্টিক প্রডিউস করা হয় তার মাত্র দুই শতাংশ প্লাস্টিক সমুদ্রে যায় আর বাকি আটানব্বই শতাংশ প্লাস্টিক মূলত নদী এবং নদীর সঙ্গে যে ফ্লাড লাইন আছে সেই লাইন দখল করে। বর্ষাকালে দেখা যাবে দেশের ৬৭ শতাংশ ভূমি পানিতে ভরে যাবে, যার ফলে প্লাস্টিক ফ্লাড লাইনে চলে যাবে। এই প্লাস্টিকগুলো নদীতে বা নদীর পাড়ের যে কৃষিজমি আছে সেখানে যেয়েও তলদেশে জমা হচ্ছে। এভাবে এটি জলজ উদ্ভিদ, জীব ও মাছের শরীরে ঢুকে আমাদের খাদ্যচক্রে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।’
আর নদী দূষণের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য। মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ঢাকার চারপাশে যে নদীগুলো আছে সে নদীতে আমরা গবেষণা করে দেখেছি যে চারশোটির মত জায়গা আছে যেখানে সরাসরি নদীর উপরে ডাস্টবিন আছে। এসব ডাস্টবিন থেকে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সরাসরি নদীতে মেশে এবং সিটি করপোরেশন সে ময়লাগুলো কালেক্ট করে না। আরেকটা বড় এলার্মিং বিষয় হচ্ছে পৌরসভাগুলোয় কোনো ভাগাড় না থাকায় তারা ময়লা নদীগুলোয় ডাম্পিং করার চেষ্টা করছে। এটার কারণে আজকের দূষণের কথা যদি বলি একসময় ঢাকা এবং চট্টগ্রাম নিয়ে দূষণের কথা বলা হতো। এখন সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূষণ ছড়িয়ে গিয়েছে।’
খাবারে মেশা প্লাস্টিক তো নীতি নির্ধারকদের পেটেও যাচ্ছে তাহলে তাদের কমিটমেন্টের অভাব কেন মনে হচ্ছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক আগেই প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পলিথিন নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন আমরা আইন করি তখন জনগণের জন্যই আইন করা হলেও আইন প্রণয়নের সাথে মানুষ যুক্ত থাকে না। যে কারণে এই আইন বাস্তবায়নযোগ্য না প্রথম থেকেই। তারপর হচ্ছে এই আইন যে বাস্তবায়ন হবে তার জন্য সরকারের নির্মোহ, সৎ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান লাগবে। সেটা যদি থাকতো তাহলে বাংলাদেশের আর পলিথিন বা প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন ছিল না।’
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘কারণ এখান থেকে যে ইকোনমিক বেনিফিটটা পাওয়া হচ্ছে সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং এরকম উন্নয়ন দরকার নাই যে উন্নয়ন মানুষের জীবন শেষ করে দেয়।’
গত বাজেটে প্লাস্টিকের উপর ভ্যাট কমিয়ে দেওয়ার ফলে দাম কমে গেল। বাজারে নেট বা কাপড়ের ব্যাগ দেওয়ার প্রচলন থাকলেও এখন সব জায়গায় পলিব্যাগই দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে শরীফ জামিল বলেন, ‘এখন আর কোনো রাখ-ঢাক নাই এবং সরকার যেন এটাকে প্রমোটও করছে। পাট থেকে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করা হলেও তা প্রমোট করা হল না। আমাদের দেশে আইন প্রনেতাদের মধ্যে তো এখন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। ফলে জনস্বার্থবিরোধী অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানুষের কল্যাণে ধরে রাখতে অবশ্যই পরিবেশের কথা ভাবতে হবে।’
এ বিষয়ে সরকার কতটা সচেতন ও কী উদ্যোগ নিয়েছে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশে পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যাগ এবং সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রণীত ‘মাল্টিসেক্টোরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ এ ২০৩০ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ ভার্জিন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার হ্রাস করা, ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা, ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃচক্রায়ন নিশ্চিত করা, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব 3R (রিডিউস, রিইউস, রিসাইকেল) নীতি নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সার্কুলার ইকোনমির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পরিবেশ নীতিতে যথাযথভাবে সামুদ্রিক প্লাস্টিক লিটার নিয়ন্ত্রণ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১ প্লাস্টিকের সার্কুলার ইকোনমি এবং ইপিআর কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্লাস্টিক দূষণের বিষয়ে টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাত ও সংরক্ষণের বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান পরিবেশ মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ২ হাজার ১৯৮টি অভিযান পরিচালনা করে ৩ হাজার ৬১৭টি মামলা করে ৫ কোটি ৪২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ধার্য করে ৫ কোটি ৪২ লাখ ১৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া ১৬৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ১,৭৪৫ মেট্রিক টন পলিথিন, দানা ও কাঁচামাল জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও ১৬টি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে। পলিথিনের বিরুদ্ধে সরকারের ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতি হিসেবে এ ধারা আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে।’
এছাড়া বন অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী সুন্দরবনে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘পর্যটকবাহী জলযান থেকে বনভূমিতে প্রবেশের সময় কোনো পর্যটক সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের মোড়ক চিপস, বিস্কুট কেক বা অন্য কোনো খাদ্য সামাগ্রীর প্যাকেট, পানি বা অন্য কোনো পানীয়ের বোতল বহন করতে না পারে তা মনিটরিং করা হচ্ছে। সুন্দরবনে ১ দিনের ট্যুর পরিচালনায় সম্পৃক্ত ট্রলার ও নৌযানগুলোতে সিঙ্গেল ইউজ খাবারের প্লেট, গ্লাস, পলিথিন ব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে।’
এছাড়া ২০২১ সালের ২১ জুন উপকূলীয় অঞ্চলের ১২ জেলার ৪০টি উপজেলাকে কোস্টাল এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করে ওইসব এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ৩ বছর মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে বলেও জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী।
সারাবাংলা/আরএফ/এমও