Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রস্তাবিত বাজেট কল্পনাবিলাসী ও বাস্তবতা বিবর্জিত: বিএনপি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৭ জুন ২০২৩ ১৬:৩০

ঢাকা: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটকে কল্পনাবিলাসী, বাস্তবতা বিবর্জিত ও উচ্চাভিলাষী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি।

বাজেট প্রস্তাবের এক সপ্তাহ পর বুধবার (৭ জুন) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সরকার ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে, তা বর্তমান ফ্যাসিস্ট লুটেরা সরকারের অর্থনৈতিক দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার এক বার্ষিক ঘোষণাপত্র মাত্র। এই বাজেট কল্পনাবিলাসী বাস্তবায়ন অযোগ্য এক উচ্চাভিলাষী বাজেট। এটা স্রেফ দুর্নীতিবাজ বর্তমান সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটের লক্ষ্যে প্রণীত অর্থ লুটেরাদের বাজেট।’

তিনি বলেন, ‘বাজেটে চলমান অর্থনৈতিক সংকট, ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে যাওয়া, বেপরোয়া অর্থপাচার, জনগণের কাঁধে রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝার বিষয়টি একবারের জন্যেও স্বীকার করা হয়নি, পরিত্রাণের উপায়ও বলা হয়নি, সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচার এর ধারণাকে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই বাজেট পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩.৪% এবং উন্নয়ন ব্যয় ৩৬.৪%। বাজেটের এই অর্থের সংস্থান হবে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আয় থেকে, আর ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা ঋনের মাধ্যমে। রাজস্ব আয়ের ৩২.৮% পরোক্ষ কর (ভ্যাট) এবং ৩০.৭% প্রত্যক্ষ কর। এরই সাথে সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.৫% এবং মুদ্রাস্ফীতির হার ৬% প্রত্যাশা করছে! এ বাজেট বাস্তবতা বিবর্জিত, প্রতারণামূলক, লোক দেখানো বাজেট, জনকল্যাণের নয়।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। এ চাপ মোকাবেলায় বাজেটে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন এবং খাদ্যসহ তেল, চাল, আদা, চিনি, ডিম, মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অনেক আগেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বাজেটে একদিকে বিনিয়োগ ২৭.৪% এ উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে।

অপরদিকে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ১ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ অংকের ঋণ যদি সরকার নিজেই নিয়ে নেয়, তবে বেসরকারি খাত নিঃসন্দেহে ঋণপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। তাহলে বিনিয়োগ আসবে কোত্থেকে? এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ কীভাবে ২৭.৪% এ উত্তীর্ণ হবে তার কোনো নির্দেশনা দেননি অর্থমন্ত্রী।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি মহাবিপর্যয়ে রয়েছে। ডলারের সংকট প্রকট। পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গেলে প্রায় সকল ব্যাংক ফিরিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। সরকারি হিসাব মতে গত ৭ বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে। আইএমএফ এর হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বিশ্বস্ত সূত্র মতে, ইতিমধ্যে নতুন নোট ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার উপর। একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

তিনি বলেন, অর্থ পাচার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। জিএফআই বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪,৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। সিআইডি বলছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য মিলে প্রতিবছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশে চারিদিকে শুধু হাহাকার। তবে এই হাহাকার সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ও সুবিধাভোগী নব্য ধনীদের জন্য নয়।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘দেশের এই চরম অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে প্রয়োজন ছিল দল, মত ও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি সাহসি ও বাস্তবসম্মত বাজেট। কিন্তু মোটা দাগে এ বাজেট আইএমএফ এর শর্ত বাস্তবায়ন এবং বিগত অর্থবছরের বাজেটের ১৪-১৫% বর্ধিত অবস্থা ছাড়া কিছুই না। অথচ আইএমএফ এর সঙ্গে ঋণচুক্তির কথা উল্লেখই করেননি অর্থমন্ত্রী। এদিকে আইএমএফ এর শর্তপূরণে বাড়তি আদায় করতে হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড় কমানোর বড় উদ্যোগ বাজেটে নেই।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেটে আয় বৃদ্ধির জন্য কর্মসংস্থানের বিশেষ কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়নি। আর কর্মসংস্থান না হলে মানুষের আয় বাড়বে না। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা তারা সামলাবে কীভাবে? সরকার ইতোপুর্বে করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদেরও ৪৪ ধরনের সেবা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে, যা মধ্যবিত্তের উপর জুলুম। প্রশ্ন হলো যার আয় কম তিনি কি ঐ সকল রাষ্ট্রীয় সেবা পাবেন না! একদিকে ন্যূনতম আয়কর সীমা বাড়িয়ে ৩,৫০,০০০ টাকা প্রস্তাব করেছে, অপরদিকে আয় না থাকলেও মিনিমাম ২০০০ টাকা আয়কর ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সাংঘর্ষিক, ন্যায়নীতি বর্জিত এবং ‘আয়ের উপর কর’ নীতিরও পরিপন্থী।’

তিনি বলেন, ‘একদিকে মধ্যবিত্তের ওপর ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, অন্যদিকে চার কোটি টাকা পর্যন্ত মোট সম্পদের ওপর কোনো সারচার্জ দিতে হবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ার বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীর জন্য কোন আশার আলো নেই। শেয়ার বাজারে সর্বস্বান্ত হাজার হাজার মানুষের আহাজারি সরকারের কানে পৌছে না। এ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শেয়ার বাজারের সংকট দূর হবে বলে কেউ বিশ্বাসও করে না। শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের উপরে গঠিত তদন্ত রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাজেট ও জিডিপির অনুপাতে এ খাতে বরাদ্দ কমেছে। বরাদ্দ বেশি দেখানোর কৌশল হিসেবে এই খাতে এমন কিছু কর্মসূচি দেখানো হয়, যা বাস্তবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই নয়। এছাড়া কৃষি খাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দেওয়া প্রণোদনার টাকাকেও সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা এবং প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে সম্প্রতি প্রতিবন্ধীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে আয়-বৈষম্য নিরোধের কৌশল সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। উপরন্তু পক্ষপাতমূলক নীতিকাঠামো আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়াচ্ছে। সরকার গরিব মানুষের জন্য বোঝা-ভ্যাট থেকে আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৬৩,৮৩৭ কোটি টাকা যা মোট আয়ের ৩২.৫%, যেখানে প্রত্যক্ষ কর থেকে আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ১৫৩,২৬০ কোটি টাকা বা ৩০.৪%। পরোক্ষ করের বোঝা যে নূন্যতম আয়ের মানুষেকেও ব্যয় করতে হয় সেটা জেনেশুনেই গণবিরোধী সরকার এ কাজটি করেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেটে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থপাচার প্রতিরোধে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে সাধারণ মানুষের অনুকূলে এ বাজেট কোনো ভূমিকা রাখবে না। এ বাজেট গণবিরোধী বাজেট। গত এক দশকে গোষ্ঠীস্বার্থে পলিসি ইস্যুজ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, রাজস্ব সেক্টর বা আর্থিক খাতসহ অন্যান্য জরুরি খাতে কাঠামোগত বড় কোনো সংস্কার করা হয়নি। এই বাজেটেও এসকল সংস্কারের কোন ইঙ্গিত নেই।’

তিনি বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশে এবার তারা স্মার্ট লুটপাটের বাজেট দিয়েছে সরকার। তারা চুরিতে স্মার্ট। ভোট চুরি, ব্যাংক চুরি, অর্থপাচার— এসব কিছুতেই। স্মার্টলি লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি করা, ব্যাংক লুটপাট, সিন্ডিকেট পরিচালনা, জনগণের সম্পদ লুটের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে এ বাজেটে। এদেরকে লুটপাটের অংশীদার বানানো হয়েছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেশের প্রধান জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে সরকারের জাবাবদিহিতা থাকে না। জবাবদিহীহীন সরকারের পক্ষে দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই জাতীয় সংকট থেকে মুক্তি পেতে জবাবদিহী ও দায়বদ্ধমূলক নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটার একমাত্র পথ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান।’

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ।

সারাবাংলা/ এজেড/এনইউ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

‘আমাদের সেনাবাহিনী যেন তৈরি থাকে’
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:২৯

আগস্টে কমেছে মূল্যস্ফীতি
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:০৭

সম্পর্কিত খবর