‘বারোমাসি’ রূপে ডেঙ্গু, রুটিন ওয়ার্কে সীমাবদ্ধ চসিক
৮ জুন ২০২৩ ২২:৩৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে ক্রমশ বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে চলতি বছর ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই’শ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। সিভিল সার্জনের কার্যালয় বলছে, শহরে ডেঙ্গু এখন বর্ষায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং সেটি এখন ‘বারোমাসি’ রোগে পরিণত হয়েছে।
তবে ডেঙ্গু মোকাবিলায় এডিস মশা নিধনে যে সংস্থার উদ্যোগী ভূমিকা পালনের কথা, সেই সিটি করপোরেশন ঘুরপাক খাচ্ছে ‘রুটিন ওয়ার্ক’ আর ওষুধ সংগ্রহের মধ্যে। সংস্থাটির কাছে মশা মারার ওষুধই পর্যাপ্ত ছিল না। এর মধ্যেই গত ৪ জুন ঢাকঢোল পিটিয়ে মশা নিধনে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করে। তবে সপ্তাহের শেষে এসে মশা মারার ওষুধ সংগ্রহে ‘সুখবর’ দিয়েছে সিটি করপোরেশন।
জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের ৮ জুনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ২০৯ জন। এর মধ্যে একজন পুরুষ ও দুই শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। ৩৪ জন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়া ১৭২ জন সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন।
গ্রামের চেয়ে আক্রান্তের হার শহরে বেশি। আক্রান্ত ২০৯ জনের মধ্যে ৬৩ জন গ্রামের। উপজেলাগুলোর মধ্যে সীতাকুণ্ডে ৩০ জন, সাতকানিয়ায় পাঁচ জন, বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলায় চার জন করে, কর্ণফুলী ও রাউজান উপজেলায় তিন জন করে, মীরসরাই, সন্দ্বীপ, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, পটিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় দুই জন করে এবং চন্দনাইশ ও বোয়ালখালীতে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তবে ফটিকছড়ি উপজেলায় এখনও ডেঙ্গু আক্রান্ত কেউ শনাক্ত হননি।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াস চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি জেনারেল হাসপাতাল এবং বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা ২০৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত পেয়েছি। এর মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে বেসরকারি হাসপাতালেও অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। আমরা বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে তাদের তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে জানানোর অনুরোধ করেছি। সরকারি হাসপাতালকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার স্থাপনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ৭৭ জনের। পরের তিন মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং এপ্রিল মাসে শনাক্ত হার কমে আসে। ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন, মার্চে ১২ জন এবং এপ্রিলে ১৮ জন শনাক্তের পর মার্চে এসে ফের ঊর্ধ্বমুখী হয় ডেঙ্গু আক্রান্তের হার। মে মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৫৩ জন।
২০২১ সালে চট্টগ্রামে ২৭১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল, মারা যায় ৫ জন। ২০২২ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৪ হাজার ৪৪৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়, মারা যায় ৪১ জন।
সিভিল সার্জন ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এই তিনমাস ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। তখন বর্ষাকাল থাকে। গতবছর আমরা ভেবেছিলাম অক্টোবর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে। কিন্তু দেখা গেছে, ডিসেম্বর এমনকি চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এরপর ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্যান্য বছরের মতো শূন্যে নামবে ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, সেটা হয়নি। প্রতিমাসেই নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগী আমরা পেয়েছি এবং সেটা অস্বাভাবিক না হলেও কমও নয়। এখন জুলাই থেকে এর প্রকোপ আরও বাড়বে, সেটা নিশ্চিত ধরে নিয়ে আমরা অ্যালার্ট আছি।’
এদিকে, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও মশা নিধনে গত পাঁচ মাসে দৃশ্যমান কোনো তোড়জোড় ছিল না সিটি করপোরেশনের। মশার কামড়ে অতীষ্ঠ নগরবাসীকে মুক্তি দিতে কোনো পদক্ষেপই দেখা যায়নি সংস্থাটির। গত রোববার (৪ জুন) সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আমেরিকা সফর শেষে চট্টগ্রামে ফেরেন। ওই দিনই সিটি করপোরেশন ৪১ ওয়ার্ডে এডিস মশা নিধনে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ চালু করে।
সূত্র মতে, সিটি করপোরেশন যখন ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে, তখন সংস্থাটির কাছে মশা মারার ওষুধ অ্যাডাল্টিসাইড মজুত ছিল মাত্র ১ হাজার ৭০০ লিটার এবং লার্ভা নিধনের ওষুধ লার্ভিসাইড ছিল মাত্র ১৮৫ লিটার। অথচ পর্যাপ্ত ওষুধ ছিটাতে গেলে প্রতিটি ওয়ার্ডে মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াই’শ লিটার অ্যাডাল্টিসাইড এবং প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লিটার লার্ভিসাইডের প্রয়োজন।
অপ্রতুল ওষুধ নিয়ে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে মশা মারার ওষুধ একেবারেই নেই, এটা সঠিক তথ্য নয়। যে ওষুধ আমাদের কাছে মজুত ছিল, সেগুলো দিয়ে আমরা ২৫ থেকে ৩০ দিন কার্যক্রম চালাতে পারি। মজুত ওষুধ দিয়েই আমরা ৪ জুন থেকে আমাদের রুটিন ওয়ার্ক জোরদার করেছি। আমাদের ৪৪ জনের টিম আছে। তাদের দিয়ে প্রতিদিন ৫-৭টি ওয়ার্ডে স্প্রে করছি।’
সূত্রমতে, গত বছরের নভেম্বরে দরপত্র আহ্বান করেও মে মাস পর্যন্ত মশা মারার ওষুধ সংগ্রহ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। ১৫ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ও ৫ হাজার লিটার লার্ভিসাইড কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল সংস্থাটি। যোগ্য প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় সেই উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয়। এর পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী কল্যাণ ট্রাস্টের কাছ থেকে সাড়ে সাত হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ও দেড় হাজার লার্ভিসাইড কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চসিক।
শরফুল ইসলাম মাহী সারাবাংলাকে জানান, বিমানবাহিনী কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে বৃহস্পতিবার (৭ জুন) প্রথম দফায় অ্যাডাল্টিসাইট ও লার্ভিসাইট পাওয়া গেছে। রোববারের মধ্যে সব ওষুধ পাওয়া যাবে। তবে সেই ওষুধ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে কার্যকর কি না পরীক্ষার পর ব্যবহার করা হবে।
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীতে সিটি করপোরেশন এক মাসেও মশা নিধনের কার্যক্রম জোরদার করতে পারবে কি না সেটা নিয়ে সন্দিহান খোদ কর্মকর্তারাই।
মশক নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি বলেন, ‘মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে নগরীতে চারশ’র বেশি স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো ধ্বংসের পাশাপাশি বাসাবাড়ির সামনে, ফুটপাতে, রাস্তায় পানি জমে থাকার স্থানগুলো চিহ্নিত করে জনসচেতনতা তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে যেসব আক্রান্ত রোগীর তথ্য আমরা পাচ্ছি, তারা কোথায় আক্রান্ত হয়েছেন সেই তথ্য আমরা সংগ্রহ করছি। আমরা জানি, এডিস মশা ৬০০ মিটারের বেশি বিচরণ করতে পারে না। সুতরাং আক্রান্ত ব্যক্তির তথ্যানুযায়ী সংশ্লিষ্ট স্পটে আমরা মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
জেলা সিভিল সার্জন ইলিয়াস চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) আমরা সিটি মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা বৈঠকে বসেছিলাম। আমরা বলেছি যে, মশা নিধনের পাশাপাশি মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করতে হবে। এজন্য শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিকল্প নেই। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা সব সংস্থা মিলে কিছু করণীয় নির্ধারণ করেছি।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম