বিশ্বব্যাপী সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
১৪ জুন ২০২৩ ২২:১১
জেনেভা: সারা বিশ্বে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় পাঁচটি প্রস্তাবনা পেশ করেছেন।
বুধবার (১৪ জুন) সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ‘ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক সামিট: সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার’ শীর্ষ সম্মেলনের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘একমাত্র সামাজিক ন্যায়বিচারই স্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করতে পারে। বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রয়াসে সামাজিক ন্যায়বিচারকে আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সকল নর-নারীর গভীর আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে আছে। ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে শান্তি কখনও স্থায়ী হতে পারে না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বর্তমান শতাব্দীর বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী একটি নতুন সামাজিক চুক্তি সম্পাদন একান্ত প্রয়োজন। এই সামাজিক চুক্তির মূল লক্ষ্য হতে পারে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সকলের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক জোট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসহ সকল আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এজেন্ডার কেন্দ্রে সামাজিক ন্যায়বিচারকে স্থান দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের সরকার জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক অংশীজনদের সঙ্গে আরও আলোচনার মাধ্যমে এ বৈশ্বিক জোটে যোগদানের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে।’
বক্তব্যে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় পাঁচটি প্রস্তাবনা পেশ করেন শেখ হাসিনা। প্রস্তাবনাগুলো হলো-
এক: এই জোটকে একটি মান-নির্ধারক বা দরকষাকষির ফোরাম হওয়ার পরিবর্তে একটি পরামর্শমূলক বা অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে তোলাই বাঞ্ছনীয় হবে।
দুই: বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-কে এক আন্তর্জাতিক মহল দিয়ে অন্য মহলের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে এই জোটকে সতর্ক থাকতে হবে।
তিন: এই জোটকে একটি নিয়মতান্ত্রিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার আওতায় সামাজিক ন্যায়বিচারকে একটি রক্ষণবাদী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে বরং এর ব্যাপক প্রসারে ভূমিকা রাখার বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে।
চার: শোভনকর্ম এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার জন্য এ জোটের বিষয়ে আইএলও’র নিজস্ব অংশীজনদের ব্যাপক সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ: তরুণ সমাজকে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রবক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই জোটকে মনোযোগী হতে হবে।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ অতীতের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাজ নির্মাণের পথে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে।’
বাংলাদেশের সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।‘
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মর্যাদা রক্ষা ও ভাগ্য পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছিলেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকারও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে দুঃখী-মেহনতি মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার একটাই লক্ষ্য, দেশের কৃষক, শ্রমিক মেহনতির মানুষের জীবনমান উন্নত করে বাংলাদেশকে দারিদ্র মুক্ত, উন্নত সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা; আমার বাবার স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ে তোলা। আমি নিজেকে উৎসর্গ করেছি এদেশের কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য।’
দেশকে শিশু শ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে চাই
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু শ্রম বন্ধে তার সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘একটি সুস্থ ও নিরাপদ আগামীর স্বার্থে আমি দেশকে শিশু শ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘শিশু শ্রমের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণে বাংলাদেশ সম্প্রতি আইএলও সনদ ১৩৮ অনুস্বাক্ষর করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ আটটি সেক্টরকে আমরা ‘শিশু শ্রম মুক্ত’ হিসেবে ঘোষণা করেছি। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত এক লাখ শিশু শ্রমিককে উপানুষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চলছে।’
নতুন দু’টি মৌলিক আইএলও সনদ অনুস্বাক্ষর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শ্রম অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ আইএলও’র দশটি মৌলিক সনদের মধ্যে আটটিতে অনুস্বাক্ষর করেছে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিষয়ক নতুন দুইটি মৌলিক আইএলও সনদ অনুস্বাক্ষরের বিষয়টিও আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি।’
আইএলও সনদে সই না করা দেশগুলোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, শ্রম অধিকার নিয়ে সোচ্চার কয়েকটি উন্নত দেশ এখন পর্যন্ত নিজেরাই আইএলও মৌলিক সনদ অনুস্বাক্ষর করেনি। যেমন একটি বড় শিল্পোন্নত দেশ মাত্র দু’টি মৌলিক সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে।’
বাংলাদেশের সার্বিক শ্রম পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শ্রমিক, মালিক ও সরকার পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় পর্যালোচনা পর্ষদ (টিসিসি) কাজ করছে বলে জানান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ সব কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সহিংসতা বা হয়রানির বিরুদ্ধে শূন্য-সহিষ্ণুতা দেখানোর নির্দেশ দেওয়ার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তরুণদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকার সমুদ্র গবেষণা, বিমানপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি ও ফ্রন্টিয়ারপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনে ডজন খানেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মহাপরিচালক, জাতিসংঘ, শ্রমিক এবং মালিকদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন। [সূত্র: বাসস]
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম