‘আমলাতন্ত্রের চেয়ারে টাওয়াল সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে’
১৬ জুন ২০২৩ ২৩:১৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো : শক্তিশালী নাগরিক সমাজ এবং আলোচনার অনুপস্থিতির কারণে চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মনে করছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।
শুক্রবার (১৬ জুন) সন্ধ্যায় নগরীর পূর্ব নাসিরাবাদের নোমান সোসাইটির ক্যাম্পাসে বেসরকারি ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এ মত তুলে ধরেন। ইডিইউ’র ‘পাবলিক লিডারশিপ, ম্যানেজমেন্ট ও গভর্নেন্স’ বিভাগের উদ্যোগে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়ন নীতি ’শীর্ষক সংলাপের প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সংলাপে আমন্ত্রিত অতিথি আবুল মোমেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম এ অঞ্চলে সবচেয়ে পুরনো শহর। ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, তাহলে ঢাকা শহর সাড়ে চার’শ বছরের, কোলকাতা সাড়ে তিন’শ বছরের আর চট্টগ্রাম হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার বছরের একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। একইসঙ্গে সমুদ্র, নদী, পাহাড়, এত বনজঙ্গল এই অঞ্চলের আর কোনো শহরে নেই। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সঙ্গে সমন্বয় করে, আবার বন্দরের কারণে এর বাণিজ্যিক গুরুত্বকে সমন্বয় করে একটি পরিকল্পিত টেকসই শহর হিসেবে আমরা চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে পারিনি।’
কেন চট্টগ্রাম পরিকল্পিত নগরী হলো না- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, চট্টগ্রামে নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠেনি, এখানে যেটা আছে সেটা আত্মীয় সমাজ। কেউ ডাক্তারের কাছে যাবেন বা হাসপাতালে যাবেন, ফোন করেন ডাক্তারের আত্মীয়কে। অথচ তিনি যে নগরের নাগরিক এবং নাগরিক হিসেবে উনার যে কথা বলার একটা বিষয় আছে সেটা উপেক্ষিত থেকে গেছে সবসময়। এ কারণে চট্টগ্রামে কোনো সিস্টেম কাজ করে না, সিস্টেমই গড়ে ওঠেনি। আমরাও নগরবাসীই হয়ে আছি, নগরের নাগরিক হতে পারিনি।’
আবুল মোমেন আরও বলেন, ‘ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। ঢাকায় একটি গতিশীল গাড়ির সর্বোচ্চ গতি একসময় ২০ কিলোমিটার ছিল, এখন সেটা চার থেকে সাত কিলোমিটারে নেমেছে। চট্টগ্রামেও কোটির কাছাকাছি মানুষ। কোলকাতা শহরে লোকসভার আসন কমাতে হয়েছে, কারণ সেখানে পপুলেশন কমে গেছে। আর ঢাকায় প্রতি নির্বাচনের আগে আসন বাড়াতে হয়, কারণ লোকসংখ্যা বাড়ছে। এভাবে পুরো দেশ মাত্র একটি বা দু’টি শহরে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়া বিপজ্জনক।’
‘কেন ঢাকা-চট্টগ্রাম শহর সম্প্রসারণ করা হলো না ? ঢাকার সঙ্গে মাত্র দুই ঘন্টায় যাতায়াত সম্ভব, এমন ৫০টা শহর নিয়ে পরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হল না কেন ? চট্টগ্রাম শহরকে সম্প্রসারণ করে কেন হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে না? অবস্থা এমন হয়েছে, দুটো শহরই ঘিঞ্জি শহরে পরিণত হয়েছে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক নগর সভ্যতার কোনো প্ল্যান নেই, কোনো পদক্ষেপ নেই। আবার শক্তিশালী নাগরিক সমাজের অনুপস্থিতির কারণে কথা বলারও কেউ নেই।’
এক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রেরও দায় আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের আমলাতন্ত্রের চেয়ারের পেছনে একটা করে টাওয়াল দেয়া থাকে। সেই টাওয়াল দিয়ে নির্ধারণ করা হয় আমলাতন্ত্রে কার মর্যাদা কতটুকু? এই টাওয়াল সংস্কৃতি তো আধুনিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না। আমলাতন্ত্রের চেয়ারে টাওয়াল সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
সংলাপে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন ঢাকার ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, ‘নগরের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যুক্ত, তাদের মাঝে সমন্বয়হীনতা প্রকট। এর প্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে দায়বদ্ধতার অভাবও বিদ্যমান। মনিটরিংকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।’
সংলাপে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ আল নোমান বলেন, ‘চট্টগ্রামকে নিয়ে নতুন করে মাস্টারপ্ল্যান এবং স্ট্রাকচার্ড প্ল্যান সাজানো প্রয়োজন। শুধু প্ল্যান করলেই হবে না, সেটা বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। সময় এবং প্রয়োজনীয়তার সাথে সাথে প্ল্যানগুলো পরিবর্তন হবে। কিন্তু নগর উন্নয়নে যদি এখনই প্রকল্প গ্রহণ না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে শহরে শুধু জনসংখ্যাই বৃদ্ধি পাবে, টেকসই উন্নয়ন হবে না।’
ইডিইউ’র উপাচার্য অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ সিকান্দার খানের সভাপতিত্বে এবং সহযোগী অধ্যাপক তাসমীম চৌধুরী বহ্নির পরিচালনায় সংলাপে আরও অংশ নেন, সিটি ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য কাজী শাহদাত কবির, বীর মুক্তিযোদ্বা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক, বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির আলি হোসাইন, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ, স্থপতি জেরিনা হোসাইন, একুশে টেলিভিশনের আবাসিক সম্পাদক রফিকুল বাহার, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডিন হামিদুল হক, রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এম এমদাদুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর।
সারাবাংলা/আরডি/একে