আ.লীগে তানভীর-শফি এগিয়ে, বিএনপিতে ভর করতে পারে ‘জামায়াত’
১৭ জুন ২০২৩ ২০:১৯
সিরাজগঞ্জ: উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার যমুনাবিধৌত সিরাজগঞ্জ। নয়টি উপজেলা নিয়ে এই জেলা গঠিত হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এলাকা অনুযায়ী আসন সংখ্যা ছয়টি। আর মোট ভোটার সংখ্যা ২৫ লাখ ১৪ হাজার ২৪০ জন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিরাজগঞ্জের ছয়টি আসনে শুরু হয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তারা গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং ফেসবুক-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থিতার সরব জানান দিচ্ছেন তারা।
এইসব আসনে বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা আর আওয়ামী লীগের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। বিএনপি ভেতরে ভেতরে গণসংযোগ চালালেও নির্বাচনি মাঠ গরম রেখেছে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, মাঠে ততই উত্তাপ ছড়াচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এখন পর্যন্ত গণসংযোগ আর উঠোন বৈঠক প্রচারণায় এগিয়ে আওয়ামী লীগ। নৌকার টিকিট পেতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা। আর সংসদের বাইরে থাকলেও নির্বাচনে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যস্ত বিএনপি।
সড়ক ও রেলযোগাযোগে সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ-৪ জেলার সবচেয়ে বৃহৎ সংসদীয় আসন। ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই উপজেলা। শস্যভাণ্ডার ও শিক্ষানগরী হিসেবে খ্যাত এই সংসদীয় আসনটি নিয়ে সব দলেরই রয়েছে বাড়তি নজর। নির্বাচনের এখনও ছয়/সাত মাস বাকি থাকলেও সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনি এলাকায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া-সলঙ্গা) আসনে টানা তৃতীয় মেয়াদ পার করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায় দলটি। অপর দিকে বিএনপির নেতাদের দাবি, নিরপেক্ষ ভোট হলে তারা বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। তবে ভোটের হিসাব-নিকাশ বলছে, এই আসনটিতে জামায়াতের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। সেক্ষেত্রে সবদল নির্বাচনে অংশ নিলে কে বিজয়ী হবেন তা বলা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
- আ.লীগে হেনরী-মিল্লাত এগিয়ে, বিএনপির একক প্রার্থী টুকু
- আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী জয়, বিএনপি এখনও নিশ্চিত নয়
- আ.লীগে আজিজ-মনসুরের পাল্লা ভারি, বিএনপির মান্নান-শিশির এগিয়ে
১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জয় পান জাতীয় পার্টির আবদুল হামিদ তালুকদার। আর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে জয়ী হন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এম আকবর আলী। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী শামছুল আলম জয়লাভ করেন। কারণ, ওই নির্বাচনে প্রায় সব দল নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু একই বছর অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নেন আওয়ামী লীগের আব্দুল লতিফ মির্জা। আর ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির এম আকবর আলী জয় পান।
তবে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে জয় ছিনিয়ে নেন শফিকুল ইসলাম শফি। আর ২০১৪ সালের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম। নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগের টিকিট পান তানভীর। সেই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ বর্তমানে তিনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
আসছে দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে এই আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা যার যার অবস্থান থেকে মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মাঠে সরব হলেও বিএনপির প্রার্থীদের তেমন একটা মাঠে দেখা যাচ্ছে না।
এই আসন থেকে আওয়ামী লীগে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম, সাবেক এমপি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম শফি, প্রয়াত এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জার মেয়ে সেলিনা মির্জা মুক্তি, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. জহুরুল ইসলাম মিল্টন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহেদুল হক, পৌর মেয়র এস.এম নজরুল ইসলাম ও সলপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি এম. আকবর আলী, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল ওয়াহাব, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সামছুল আলম ও কে.এম শরফুদ্দিন মঞ্জু, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সিমকী ইমাম খান। এ ছাড়া জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বলে জানা গেছে। এদের বাইরে ইসলামী আন্দোলনের উপজেলা সভাপতি মুফতি আবদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মনসুরের নাম প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি এম. আকবর আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে তাদের অধীনে নির্বাচন হোক। যদি এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে জনগণ ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না। পুলিশ প্রশাসন দিয়ে জোর করে ভোট নেওয়া হবে। তাই তাদের কেউ হারাতে পারবে না। সেজন্য এই সরকারের অধীনে বিএনপি ভোটে যাবে না। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে, মানুষ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বিএনপিকে ভোট দিবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমপি থাকাকালীন উল্লাপাড়ার শিক্ষাখাতসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। যার ফল জনগণ এখনো পাচ্ছে। উল্লাপাড়ায় এম.আকবর আলীর বিকল্প নেই।’
সাবেক এমপি ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলাম। এর পর নির্বাচনি এলাকার রাস্তা-ঘাট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছি। পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন না পেলেও দলের জন্য মাঠে থেকেছি। রাজনীতির শুরু থেকেই সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে আসছি। যোগ্যতা বিবেচনায় আমি মনোনয়ন পাব বলে আশা করছি। মনোনয়ন পেয়ে এমপি হতে পারলে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দলকে সু-সংগঠিত করতে কাজ করে যাব।’
যুবলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. জহুরুল ইসলাম মিল্টন সারাবাংলাকে, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সিরাজগঞ্জ-৪ আসন থেকে আমি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। আমাকে যদি মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং যদি নির্বাচিত হই, তাহলে এই এলাকার জনগণের সুষম উন্নয়ন করব। এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের উন্নয়নে সচেষ্ট হব। সর্বোপরি উল্লাপাড়া ও সলঙ্গাকে সারা দেশের মধ্যে একটি মডেল নির্বাচনি এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করব।’
উল্লেখ্য, এই আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪২০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৬, নারী ভোটার ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৯ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার পাঁচ জন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন মোট চার জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে এম আকবর আলী (ধানের শীষ) প্রতীক পেয়েছিলেন ২৪ হাজার ৪৬০ ভোট, মো. আবু ইসহাক (তারা) ৬১১ ভোট, জামায়াতের রফিকুল ইসলাম খান (দাড়িপাল্লা) ৯৭ হাজার ৪৬৩ ভোট এবং মো. শফিকুল ইসলাম (নৌকা) ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০৩ ভোট পেয়ে জয়ী হন।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে নৌকার প্রার্থী তানভীর ইমাম সবাইকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে আব্দুর রহমান (হাতপাখা) পেয়েছিলেন ১ হাজার ৭৯৬ ভোট, তানভীর ইমাম (নৌকা) পান ৩ লাখ ৩ হাজার ৭০৬ ভোট, মো. জহির রায়হান (গোলাপ ফুল) পেয়েছিলেন ৬৬৫ ভোট, রফিকুল ইসলাম খান (ধানের শীষ) পান ২৪ হাজার ৮৯৩ ভোট এবং মো. মুকুল হোসেন ৪০৬ ভোট ভোট পান।
সারাবাংলা/আরএ/পিটিএম
এম. আকবর আলী তানভীর ইমাম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন রফিকুল ইসলাম খান শফিকুল ইসলাম শফি সিমকী ইমাম খান