আ.লীগে দ্বন্দ্ব থাকলেও মমিন এগিয়ে, এখনও মাঠে নামেনি বিএনপি
১৮ জুন ২০২৩ ০৮:০০
সিরাজগঞ্জ: উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার যমুনাবিধৌত সিরাজগঞ্জ। নয়টি উপজেলা নিয়ে এই জেলা গঠিত হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এলাকা অনুযায়ী আসন সংখ্যা ছয়টি। আর মোট ভোটার সংখ্যা ২৫ লাখ ১৪ হাজার ২৪০ জন। এরইমধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিরাজগঞ্জের ছয়টি আসনে শুরু হয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তারা গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং ফেসবুক-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থিতার সরব জানান দিচ্ছেন তারা।
এইসব আসনে বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা আর আওয়ামী লীগের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। বিএনপি ভেতরে ভেতরে গণসংযোগ চালালেও নির্বাচনি মাঠ গরম রেখেছে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, মাঠে ততই উত্তাপ ছড়াচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এখন পর্যন্ত গণসংযোগ আর উঠোন বৈঠক প্রচারণায় এগিয়ে আওয়ামী লীগ। নৌকার টিকিট পেতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা। আর সংসদের বাইরে থাকলেও নির্বাচনে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যস্ত বিএনপি।
তাঁতশিল্প সমৃদ্ধ দুটি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি ও চৌহালি) আসন। জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন এটি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চৌহালি ও বেলকুচি উপজেলা পৃথক আসন ছিল। তখন সিরাজগঞ্জ-৬ ছিল চৌহালি উপজেলা নিয়ে গঠিত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বেলকুচি ও চৌহালিকে একত্রিত করে সিরাজগঞ্জ-৫ আসন হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আর শাহজাদপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় সিরাজগঞ্জ-৬ আসনটি।
এই আসনটি বর্তমানে আওয়ামী লীগের দখলে। এখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য বিশিষ্ট শিল্পপতি প্রয়াত এমপি আব্দুল মজিদ মন্ডলের ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মমিন মন্ডল। এবারও তিনি এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন। তবে তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদ’র চেয়ারম্যান ও সাবেকমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ বিশ্বাস। বলতে গেলে, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের রাজনীতিতে এই দু’জনের বিরোধ প্রকাশ্য। লতিফ বিশ্বাসের স্ত্রী আশানূর বিশ্বাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এর আগে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সরাসরি এমপি মমিন মন্ডলের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছেন। সেজন্য বলা যায়, এই আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে।
তবে এই আসনে এখন পর্যন্ত বিএনপির সম্ভাব্য কোনো প্রার্থীকে মাঠে দেখা যায়নি। তাই মনোনয়ন নিয়ে তাদের দ্বন্দ্বের কথা জানা যায়নি। কিন্তু স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনোনয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমকেই এগিয়ে রাখছেন।
আরও পড়ুন:
- আ.লীগে হেনরী-মিল্লাত এগিয়ে, বিএনপির একক প্রার্থী টুকু
- আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী জয়, বিএনপি এখনও নিশ্চিত নয়
- আ.লীগে তানভীর-শফি এগিয়ে, বিএনপিতে ভর করতে পারে ‘জামায়াত’
- আ.লীগে আজিজ-মনসুরের পাল্লা ভারি, বিএনপির মান্নান-শিশির এগিয়ে
১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে নির্বাচিত হন মফিজ উদ্দিন তালুকদার। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শহিদুল ইসলাম খান জয়লাভ করেন। আর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে জয় পান বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সহিদুল্লাহ খান। তিনি ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনেও জয়লাভ করেন। কিন্তু একই বছর অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। তবে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের বিএনপির দখলে চলে যায় আসনটি। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি এম মোজাম্মেল হক জয়লাভ করেন।
৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনজুর কাদেরকে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। ২০১৪ সালের ১০ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুল মজিদ মন্ডল। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমানকে পরাজিত করেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান মজিদ মন্ডলের পুত্র আবদুল মমিন মন্ডল। নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে পরাজিত করে বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
বর্তমানে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেন- বর্তমান সংসদ সদস্য ও বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মমিন মণ্ডল, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেকমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ বিশ্বাস, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আকন্দ, ঢাকার বনানী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর মোশাররফ হোসেন এবং চৌহালী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম, কেন্দ্রীয় তাঁতীদলের যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম মওলা খান বাবলু, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি রাকিবুল করিম খান পাপ্পু। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সাবেক জেলা আমির অধ্যক্ষ আলী আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে বেলকুচি উপজেলা সভাপতি আবদুস সামাদ, সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার লোকমান হোসেনের নাম শোনা যাচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনই নির্বাচনের প্রার্থিতা নিয়ে ভাবছি না। আগে সরকার পদত্যাগ করুক। নির্বাচনে পরিবেশ তৈরি হোক, তার পর এ সব নিয়ে ভাবা যাবে। কেবলমাত্র নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি অংশ নেবে। সেক্ষেত্রে তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা আসবে। তবে দল যদি ওই সময় আমাকে মনোনয়ন দেয় আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।’
নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে চৌহালি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. তাজ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসন্ন সংসদ নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুল মমিন মন্ডল। তিনি বেলকুচি ও চৌহালির প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে যান। বিশেষ করে তার প্রচেষ্টায় চৌহালির মানুষের প্রাণের দাবি নদী ভাঙন রক্ষায় বাঁধ, চৌহালি উপজেলা কমপ্লেক্সের নতুন ভবন নির্মাণ এবং গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা-ঘাট নির্মাণ হচ্ছে। সেজন্য আগামী নির্বাচনে তাকে এই আসন থেকে মনোনয়ন দিলে তিনি মানুষের কল্যাণে তার অব্যাহত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারবেন।’
মনোনয়ন প্রসঙ্গে বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশানুর বিশ্বাস বলেন, ‘বর্তমান এমপি মমিন মন্ডল টাকাওয়ালা মানুষ। তিনি সবকিছু অর্থ দিয়েই করতে চান। কিন্তু রাজনীতিতে টাকা নয়, থাকতে হয় গ্রহণযোগ্যতা। তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নাই। সিরাজগঞ্জ-৫ আসন থেকে সাবেকমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের কোনো বিকল্প নাই। লতিফ বিশ্বাসের ভোট টাকা দিয়ে কিনতে হয় না। এ অঞ্চলের মানুষ মন থেকে তাকে ভালোবাসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে যদি কোনো কারণে লতিফ বিশ্বাস নির্বাচন না করতে পারেন তাহলে এই আসন থেকে আমি মনোনয়ন চাইব।’
উল্লেখ্য, এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪ হাজার ২৩৮ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯৪ হাজার ৯১জন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন মোট চার জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে জয়ী হন নৌকার প্রার্থী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। নির্বাচনে ডা. মুহা. হাসান আলী তালুকদার (গামছা) পেয়েছিলেন ৪৩২ ভোট, মেজর (অব.) মনজুর কাদের (ধানের শীষ) পেয়েছিলেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৩০ ভোট, মো. আব্দুল মান্নান (হাতপাখা) পান ২ হাজার ৬৬২ ভোট এবং আব্দুল লতিফ বিশ্বাস (নৌকা) ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৮১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।
২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে মোট ছয় জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত আব্দুল মমিন মন্ডল। নির্বাচনে মমিন মন্ডল (নৌকা) পেয়েছিলেন ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬১ ভোট, মো. আমিরুল ইসলাম খান (ধানের শীষ) পান ২৮ হাজার ৩১৭ ভোট, আলী আলমের (স্বতস্ত্র) প্রাপ্ত ভোট ছিল ১১০, মো. মোক্তার হোসেন (লাঙ্গল) পেয়েছিলেন ৬৫৯ ভোট, মো. লোকমান হোসেন (হাতপাখা) পান ২৫০৪ ভোট এবং মো. আব্দুর নুরের প্রাপ্ত ভোট ৭৭২।
সারাবাংলা/আরএ/পিটিএম
আবদুল মমিন মন্ডল আবদুল লতিফ বিশ্বাস আমিরুল ইসলাম খান আলীম আশানুর বিশ্বাস দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মীর মোশাররফ হোসেন