আদালতে করা ৪০ ভাগ মামলা ‘মিথ্যা’
১৮ জুন ২০২৩ ০৯:১২
যশোর: যশোর আদালতে দাখিল হওয়া মামলার ৪০ শতাংশই ‘মিথ্যা’। পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো অথবা নিজের অপরাধ ঢাকতে এ ধরনের মামলা করা হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। আর এ ধরনের মামলায় আদালতে মামলার পাহাড় জমছে।
২০২২ সালে আদালত থেকে তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেওয়া হয় এক হাজার ৬১৩টি মামলা। চলতি বছরের ৫ মাসে ৫৬৭টি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পিবিআই। তদন্তের ফলাফল চিত্রে মিথ্যা মামলার তথ্য উঠে আসে। তাছাড়া ২০ শতাংশ মামলা একপর্যায়ে বাদী-বিবাদী মিলে তুলে নেয়।
আইনজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত আইনে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা মামলাকারীকে কোনো শাস্তি দেয় না। মাঝখান থেকে বিবাদীর জীবন হয় অতিষ্ঠ ও বিষময়। অবশ্য হয়রানির শিকার ব্যাক্তি পাল্টা মামলা করতে পারেন। প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার জন্যে দেওয়া এসব মামলা দীর্ঘদিনের তদন্ত শেষে যখন মিথ্যা প্রামাণিত, হয় তখন বিবাদীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নতুন করে মামলা দিয়ে ক্ষতিপূরণ বা মিথ্যা মামলায় জড়ানোর অপরাধে শাস্তি দেওয়ার মানসিকতা থাকে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাদী প্রতিপক্ষকে যথেষ্ট ঘায়েল না করতে পারলে তদন্ত রিপোর্টের ওপর আবার নারাজি পিটিশন দেন এতে আবারও দীর্ঘ হয় মামলা কার্যক্রম। জমি-জমা এবং নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে এ জাতীয় মামলা বেশি চলে। এসব কারণে দিন যত যাচ্ছে আদালতে মামলার স্তূপ তত বাড়ছে এবং বিচার প্রার্থীদেরও বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে।
বিভিন্ন মামলার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, মামলার সব চেয়ে বড় ক্ষতি বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘোরা। কাজকর্ম ফেলে রেখে কোর্টে যেতে হয়, হাজিরা দিতে হয়, পুলিশ সংশ্লিষ্ট থাকলে তদন্তের সময় আরও বেশি নাজেহাল হতে হয়, তেমনি সামাজিক মর্যাদাও নষ্ট হয়। বছরের পর বছর দৌড়াদৌড়ি করতে থানা, পুলিশ, উকিল, আইনজীবী সহকারীদের যেমন নিয়মিত বিভিন্ন খাতে অর্থ দিতে হয়, তেমনি পরিবহন, যোগাযোগেও অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, দিনরাত্রির ঘুম হারাম হয়ে যায়, পারিবারিক সুখ-শান্তি নষ্ট হয়।
মণিরামপুর ও কেশবপুরের কয়েকজন বিবাদী জানান, আদালতের নির্দেশে পুলিশ তদন্ত করার পর ফাইনাল রিপোর্ট দিলেও বাদীরা তা না মেনে পুনঃতদন্তের জন্যে আবেদন করায় তাদের দৌড়াদৌড়ি শেষ হচ্ছে না।
দু’বছর আগে দুদকের মামলায় জড়িয়ে যাওয়া একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘দেড় বছর ধরে মামলার চার্জশিট না হওয়ায় পিআরএলসহ চাকরির সব সুবিধা বন্ধ রয়েছে। ঝুলে আছি, এলাকার মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারি না। সন্তান কলেজ থেকে ফিরে রাতে তাদের মায়ের কাছে কাঁদে, তারা বাবাকে নিয়ে বাইরে কিছু বলতে পারে না। অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করতে এমনভাবে ফেঁসে গেছি। তদন্ত শেষ হলে হয়তো নিরাপরাধ প্রমাণ হবো, তবে আমার জীবনের এই সময়, আমার সন্তানদের এই কান্নার কি কোনো প্রতিকার হবে? অথচ, সময় মতো তদন্ত শেষ এবং চার্জশিট হলে সাজা অথবা মুক্তি কিছু একটা মিলত। এই দুর্বিষহ জীবন থাকতো না।’
যশোর জেলার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অফিস সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত ২০২২ সালে পিবিআই যে সিআর মামলা তদন্ত করে তার মধ্যে ৪০.১৯ শতাংশ মামলা প্রমাণিত, ৪০.৫৯ শতাংশ অপ্রমাণিত (মিথ্যা) এবং ১৯.২২ শতাংশ মামলা সর্বশেষে মিউচুয়াল হয় অর্থাৎ উভয়পক্ষ সম্মত হয়ে প্রত্যাহার করে নেয়।
সূত্রমতে, ওই বছর মোট ১ হাজার ৬১৩টি মামলা তার আদালতের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব পায় প্রতিষ্ঠানটি। একই বছর তারা মোট ১ হাজার ৪৯৮টি মামলা তদন্ত শেষ করে। সেখানে ৬০২টি প্রমাণিত, ৬০৮টি অপ্রমাণিত এবং ২৮৮টি মিমাংসা করে পক্ষদ্বয়।
প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের চলতি মাস পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, ৫৬৭টি মামলা পায়, এর মধ্যে পূর্বের মামলাসহ ৬৮১টি মামলা তদন্ত শেষ হয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট হয়েছে। চূড়ান্ত রিপোর্ট হওয়া ৩০২টি প্রমাণিত, ২৮৭ টি অপ্রমাণিত এবং ৯২টি মিমাংসায় নিষ্পত্তি হয়েছে।
মিথ্যা মামলায় সাজা হওয়া না হওয়া এবং মানুষের ভোগান্তি নিয়ে পিপি অ্যাডভোকেট মো. ইদ্রিস আলী জানান, বিভিন্ন তদন্ত ও বিচার পর্যায়ে গিয়ে মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনের আশ্রয় নিতে পারে। তারা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে পারে। মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে বিচারক কোনো শাস্তি দেন না, যতক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনের কাছে প্রতিকার না চান।
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন মামলা চালাতে চালাতে ক্লান্ত বিবাদীরা আর নতুন করে মামলার ফাঁদে জড়াতে আগ্রহ হারান। তবে এ জাতীয় মামলায় জড়িয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হন মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিবাদী।’
পিবিআই যশোরের পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন বলেন, ‘সিআর মামলার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা তদন্ত শেষে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। গড়ে হিসেব করলে দেখা যায় ৪০ শতাংশের বেশি মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কোনো কোনো মাসের ফলাফল আরও খারাপ হয়। সে পরিসংখ্যানে অপ্রাণিত মামলার সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়। দেখা যাচ্ছে জমি-জমা বা মারামারির ঘটনায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বা অপহরণ মামলা দায়ের করে। তদন্ত শেষে প্রকৃত তথ্য উঠে আসে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন চলার পর বাদী-বিবাদী একপর্যায়ে নিজেরা মীমাংসা করে নেয়।’
সারাবাংলা/এমও