জেলেদের নিরাশ করেনি হালদা, রেকর্ড ডিম সংগ্রহ
১৯ জুন ২০২৩ ২০:০৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো : হালদা পাড়ের জেলেদের নিরাশ করেনি তাদের ‘মা মাছ’। এত ডিম দিয়েছে, প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি বলছেন জেলেরা। বরং সংগ্রহের সক্ষমতার চেয়ে বেশি হওয়ায় আরও ডিম নদীতে রেখেই তাদের ফিরতে হয়েছে। প্রকৃতির বিরূপতার মধ্যে তিনমাস অপেক্ষার পর এত ডিম পেয়ে উল্লাসে মেতেছেন জেলেরা। যদিও এখনও নির্ধারণ হয়নি, তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- এবার ডিম সংগ্রহের পরিমাণ গত তিন বছরের রেকর্ড ছাড়াবে।
প্রতি বছর চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে পূর্ণিমা-অমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে হালদা নদীতে। আর তখনই তাপমাত্রা অনুকূলে থাকলে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ। সাধারণত মধ্য এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ। তবে ডিম আহরণের তোড়জোড় শুরু হয় মার্চের শেষদিক থেকে। নৌকা আর জাল নিয়ে হালদা নদীতে অপেক্ষায় থাকেন জেলেরা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
জেলেদের অপেক্ষার মধ্যেই রোববার (১৮ জুন) দুপুরে এবং গত ১৮ মে দুই দফায় সামান্য পরিমাণে ডিম ছাড়ে রুই, মৃগেল, কাতলা ও কালিবাউশ- এই চার প্রজাতির প্রজনন সক্ষম মাছ। সংগ্রহকারীরা সেগুলোকে ‘নমুনা ডিম’ বলেছিলেন। ১৫ জুন থেকে শুরু হয়েছিল আমবস্যা তিথি, ২১ জুন শেষ হওয়ার কথা। এ সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ডিম না ছাড়লে জেলেদের নদী থেকে ফিরে আসার কথা ছিল। বৃষ্টিপাতহীন গরম আবহওয়া, পাহাড়ি ঢলের অনুপস্থিতির মধ্যে মা মাছ ডিম ছাড়বে না, এমনটাই মেনে নিয়ে জেলেরা ফেরার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন।
কিন্তু এই বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই রোববার রাত ১১টার পর থেকে হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট থেকে রাউজানের রামদাশ মুন্সির ঘাট পর্যন্ত হালদা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। ২৮৫ থেকে ২৯০টি নৌকা নিয়ে পাঁচ শতাধিক জেলে এবার ডিম সংগ্রহ করেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী।
আজিমের ঘাট এলাকায় ডিম সংগ্রহ করেছেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে নদীতেই ছিলাম। তিন জো (তিথি) চলে গেল, ভেবেছিলাম ডিম বোধহয় আর পাব না। আল্লাহর কী রহমত, গত (রোববার) রাতে দেখি হঠাৎ মা মাছ ডিম ছেড়ে দিল। এবার আমরা খুব খুশি, খুব ভালো ডিম পেয়েছি।’
রামদাশ মুন্সির ঘাটের বাবুল জলদাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘চারটা নৌকা নামিয়েছিলাম। চার বালতি ডিম পেয়েছি। সব হ্যাচারিতে দিয়ে দিয়েছি। এবার ডিম অন্যান্যবারের চেয়ে অনেক ভালো পেয়েছি।’
১১ বালতি ডিম সংগ্রহের পরও মো. রফিকের আক্ষেপ, কেন তিনি আরও নিতে পারলেন না ! রফিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার দুইটা কুয়া, একটাতে ছয় বালতি, আরেকটাতে পাঁচ বালতি ঢেলেছি। আল্লাহ এমনভাবে দিছে, আরও অনেক ডিম নদীতে রেখেই এসে গেছি। আমার তো আর কুয়া নেই। এনে কী করব, নষ্ট হতো !’
অঙ্কুরীঘোনার সুকুমার জলদাস সারাবাংলাকে বলেন, ’২০ বালতি ডিম পেয়েছি। আগে কোনোদিন এত ডিম পাইনি। এত ডিম পাব ভাবিওনাই।’
কী পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয়েছে, জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারারাত ডিম নিয়েছে জেলেরা। আমরা সেখানে ছিলাম। ডিম সংগ্রহের সময় পরিমাণ জিজ্ঞেস করলে ওনারা বিরক্ত হন। এই মুহূর্তে পরিমাণ নির্ধারণ করা কঠিন। এ বিষয়ে সরকারিভাবে গঠিত একটি কমিটি আছে। কমিটি তথ্য সংগ্রহ করছে। যাচাইবাছাইয়ের পর পরিমাণ জানাতে পারব।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও প্রতিবছর ডিম সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘একক নৌকাভিত্তিক ডিম সংগ্রহের পরিমাণ এবার খুব ভালো। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। আমরা সরকারি কমিটির সঙ্গে মিলে পরবর্তীতে সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ করব।’
টানা বর্ষণ-পাহাড়ি ঢল ছাড়ায় ‘কার্প জাতীয়’ প্রজনন সক্ষম মাছ এত ডিম ছাড়বে, এমন আশা করেননি খোদ মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা এবং হালদা গবেষকরাও। তাই যে ডিমগুলো নদীতে রেখে ফিরতে হয়েছে, সেগুলো নষ্ট হওয়া নিয়ে জেলেদের পাশাপাশি তাদেরও আক্ষেপের শেষ নেই।
ফারহানা লাভলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসলে হঠাৎ করে এত ডিম দিয়েছে, জেলেরা সব ডিম সংগ্রহ করতে পারেননি। আবার অনেকে ইচ্ছে করেও সংগ্রহ করেননি। কারণ সেগুলো রাখবে কোথায়? এত কুয়া-হ্যাচারি তো প্রস্তুত নেই। তিন বছর আগে ২৫ হাজার কেজির মতো ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ শেষপর্যন্ত সংরক্ষণ করে রেণু ফোটানো যায়নি।’
‘এখন যেগুলো নদীতে রয়ে গেছে, সেগুলোর মধ্যে সব যে নষ্ট হয়ে যাবে তা নয়। হালদা জোয়ার-ভাটার নদী। কিছু ডিম থেকে হয়তো রেণু প্রাকৃতিকভাবে নদীতেই ফুটবে। আবার ভাটার টানে সাগরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।’
মনজুরুল কিবরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘মার্চের শেষদিক থেকে ডিমের জন্য নদীতে অপেক্ষা শুরু হয়। এবার ১৫ জুন থেকে আমবস্যার জো (তিথি) শুরু হয়েছে। ২১ জুন পর্যন্ত জোয়ের মেয়াদ আছে। ডিম না ছাড়লে ২১ জুনের পর জেলেরা নদী থেকে উঠে আসত।’
‘কিন্তু এবার ব্যতিক্রম দেখা গেল, সেভাবে লাগাতার বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল না থাকার পরও মা মাছ ডিম ছেড়ে দিল। আমরা ডিম সংগ্রহকারীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের উৎফুল্ল মনে হয়েছে। অর্থাৎ ডিমের পরিমাণ ভালো।’
মনজুরুল কিবরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘হালদা নদীতে ন্যাচারালি ডিম থেকে রেণু ফোটার কোনো নজির নেই। সেটা যদি হতো তাহলে হালদা পানি আর রেণুতে একাকার হয়ে যেত। শুধুমাত্র মানুষ ডিম সংগ্রহ করে যেগুলো রেণু ফোটায় সেগুলো বাঁচে। বাকিগুলো পানির তোড়ে সাগরে চলে যায়। অনুকূল পরিবেশে রেণু ফুটলেও পানির তোড়ে বাঁচে না। অনেক জেলে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সংগ্রহের পর বাকি ডিম রেখে চলে এসেছেন। নিশ্চিতভাবে ডিমগুলো নষ্ট হয়ে গেছে হিসেবে ধরতে হবে।’
চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে আছে হালদা নদী। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে হালদায় রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি এবং ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল।
এ ছাড়া ২০২২ সালে ৮ হাজার কেজি , ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর আগে ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
সারাবাংলা/আরডি/একে