Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আফিলের দুর্গ ভাঙতে চান লিটন, ‘তৃপ্তি’তে তুষ্ট নয় বিএনপি

তহীদ মনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২০ জুন ২০২৩ ০৮:০০

যশোর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কপোতাক্ষ নদ, নকশিকাঁথা, খেজুরের গুড় আর জামতলার রসগোল্লা— প্রসিদ্ধ এসব জিনিস নিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি যশোর। এই জেলার সংসদীয় আসন ছয়টি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আসনগুলোতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বড় দল এবং দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকায় এই জেলার প্রায় প্রতিটি আসনে এবার দলের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই মাঠে নেমেছেন। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কেন্দ্রেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক জায়গায় অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবার কথা একটিই— নেত্রী যাকে নৌকা দেবেন তার জন্য সবাই একযোগে কাজ করবেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। আর কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাঠে আছে স্থানীয় বিএনপি। তবে দলটির নেতাকর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের মাঠে নামেনি। কোথাও নির্বাচনমুখী প্রচার বা দলীয় কর্মকাণ্ড নেই তাদের। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত দিলে নির্বাচনমুখী হবেন তারা। সেক্ষেত্রে যাকেই ধানের শীষ দেওয়া হোক না কেন সবাই তার জন্য কাজ করবেন। তাই নমিনেশন পাওয়া নিয়ে দলটিতে লড়াইয়ের তেমন তীব্রতা নেই। অপরদিকে, জাতীয় পার্টিরও আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড তেমন চোখে পড়েনি। আর নিবন্ধন ও রাজনৈতিক জটিলতায় জামায়াতে ইসলামীর দলীয় অবস্থানও সেভাবে চিহ্নিত হয়নি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বোঝা যাবে তারা কীভাবে, কাদের সঙ্গে মাঠে অবস্থান নেবে।

বিজ্ঞাপন

এক সময়ে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল যশোর-১ (শার্শা) আসনটি। মাঝখানে সেটি বিএনপি-জামাতের দখলে ছিল। পরে তিনবারের নৌকার মাঝি শেখ আফিল উদ্দিন এমপি’র হাত ধরে আসনটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার তিনি টানা তিনবারের সংসদ সদস্য হওয়ায় ‘গৃহবিবাদ’ও আছে। ফলে নির্বাচনের মাঠে তার দলীয় একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বীও রয়েছে। আবার আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে না নামলেও বিরোধের রেখা রয়েছে বিএনপিতেও। দলটি নির্বাচনে গেলে সেখানেও ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন একাধিক প্রার্থী।

তথ্য মতে, যশোরের শার্শা উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে যশোর-১ আসন গঠিত। এই আসনের মধ্যে রয়েছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। সবদলের জন্য এই আসনটি মর্যাদার। বিগত ১১টি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছয় বার, বিএনপি তিন বার, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত একবার করে বিজয়ী হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই আসনে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার (তৎকালীন যশোর-৫), ১৯৭৯ সালে বিএনপির আলী তারেক, ১৯৮৬ সালে জামায়াতের নূর হুসাইন, ১৯৮৮ সালে স্বতন্ত্র কেএম নজরুল ইসলাম, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির মফিকুল হাসান তৃপ্তি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার, ২০০১ সালে বিএনপির আলী কদর, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের শেখ আফিল উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে শেখ আফিল উদ্দিন পুনরায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে শেখ আফিল উদ্দিন তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

যশোর-১ (শার্শা) আসনের রাজনীতিসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও স্থানীয়রা জানান, এবারও শক্ত প্রার্থী টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের শেখ আফিল উদ্দিন। পাশাপাশি দলীয় বিভাজনের সূত্র ধরে মাঠে রয়েছেন বেনাপোলের সাবেক পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন। এছাড়া দলীয় মনোনয়নের জন্য মাঠে নেমেছেন নতুন মুখ যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নাজমুল হাসান।

অন্যদিকে, নির্বাচনে এলে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন সাবেক কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ও বিগত নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী মফিকুল হাসান তৃপ্তি। পাশাপাশি মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন শার্শা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুজ্জামান মধু ও সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান জহির। বড় দু’টি দলের বাইরে জাতীয় পার্টি বা জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর তৎপরতা এখনও দৃশ্যমান হয়নি।

২০০১ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আসা বিশিষ্ট শিল্পপতি শেখ আফিল উদ্দিন প্রথম নির্বাচনে পরাজিত হলেও পরে দল পুনর্গঠন ও সুসংহত করতে কাজ করেন। এ জন্য প্রথম দিকের এক দশক ধরে শার্শা ও বেনাপোলে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্ব দেন তিনি। ২০০৮ সালে তাই ঝামেলা ছাড়াই তিনি নৌকার মাঝি হয়েছিলেন। কিন্তু এরপরই দলে বিভক্তি শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আশরাফুল আলম লিটনের সাথে শেখ আফিল উদ্দিনের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। বিগত নির্বাচনের তিনি আফিল উদ্দিনের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি। এখনও এই দুই নেতাকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে।

নির্বাচন নিয়ে শেখ আফিল উদ্দীন এমপি সারাবাংলাকে, ‘দল সুসংগঠিত করতে কাজ করেছি, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নিয়েছি। আমি চাই বিএনপি নির্বাচনে আসুক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক। তবে সরকারের উন্নয়ন মনে রেখে মানুষ আবারও নৌকাকে জয়ী করবে।’

শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু সারাবাংলাকে বলেন, ‘শার্শায় শেখ আফিল উদ্দিনের বিকল্প নেই। শার্শায় আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত ও সরকারিভাবে উপজেলায় অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। তিনি রাজনীতির সঙ্গে আছেন, গণমানুষের সঙ্গে। নৌকার নমিনেশন অনেকেই চাইতে পারে। তবে শার্শায় শেখ আফিল উদ্দিনের বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি।’

তবে বেনাপোল পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শেখ আফিল উদ্দিন প্রতিবারই নমিনেশন পাবেন, এমন নয়। আওয়ামী লীগ অনেক বড় সংগঠন। সেখানে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার মতো অনেক যোগ্য নেতা রয়েছেন। আমি ৩১ বছর ধরে রাজনীতিতে সক্রিয়। বেনাপোলের মেয়র হিসেবে আমি অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আমি নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলাম, এবারও চাইব। দল যদি মনে করে তাহলে মনোনয়ন দেবে। আর মনোনয়ন না দিলেও নৌকার সঙ্গে কাজ করব।’

বিএনপিসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মফিকুল হাসান তৃপ্তি দীর্ঘদিন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। তাকে নিয়ে স্থানীয় বিএনপিতে বিরোধ রয়েছে। বিগত নির্বাচনের আগে তার বহিষ্কারাদেশ তুলে নিয়ে ধানের শীষের মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী এখনও তাকে মেনে নিতে পারেননি। নির্বাচন নিয়ে মফিকুল হাসান তৃপ্তি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির কাণ্ডারি তারেক রহমানের নির্দেশনায় রাজনীতির মাঠে আছি। নির্বাচন নিয়ে তিনি যে নির্দেশ দেবেন, মাঠ পর্যায়ে তা প্রতিপালন করা হবে। দল নির্বাচনে গেলে ধানের শীষের মনোনয়ন চাইব। দল নির্বাচনে গেলে জয়ের ব্যপারে আমি আশাবাদী।’

উল্লেখ্য, যশোর-১ (শার্শা) আসনে মোট ভোটার ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ৫০৯ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৫। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে যশোর-১ (শার্শা) আসনে দুই লাখ ৯ হাজার ৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী মফিকুল হাসান তৃপ্তি পেয়েছিলেন চার হাজার ৮০২ ভোট। এর আগে, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে শেখ আফিল উদ্দিন ৯৪ হাজার ৫৫৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের আজিজুর রহমান পেয়েছিলেন ৮৮ হাজার ৭০০ ভোট।

সারাবাংলা/টিএম/পিটিএম

আশরাফুল আলম লিটন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মফিকুল হাসান তৃপ্তি যশোর-১ (শার্শা) শেখ আফিল উদ্দীন সিরাজুল হক মঞ্জু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর