সেন্ট্রাল হাসপাতাল আমার নামে অনিয়ম করেছে: ডা. সংযুক্তা
২০ জুন ২০২৩ ১৩:২৫
ঢাকা: রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. সংযুক্তা সাহা। তিনি বলেন, সেন্ট্রাল হসপিটাল আমার নাম ব্যবহার করে অনিয়ম করেছে। তারা এমন অনিয়ম করবে ভাবতেও পারিনি। এ ঘটনার আগ পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আমি ছিলাম গর্ব। আর এখন তারা আমার নামে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। তারা বলছে আমি বেশি রোগী দেখি। অথচ তারা সব সময় বেশি রোগী দেখতে আমাকে উৎসাহিত করেছে। তারা আমার চেম্বারের পাশে ঘুমানোর জন্য বেডের ব্যবস্থাও করেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ষড়যন্ত্র করে তাকে ভিলেন বানিয়েছে বলেও দাবি করেন ডা. সংযুক্তা সাহা। মঙ্গলবার (২০ জুন) সকালে রাজধানীর পরীবাগের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
এ দিন ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে নিজের ওপর আরোপিত অভিযোগের জবাব দিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ডা. সংযুক্তা সাহা।
তিনি বলেন, ‘আমিও একজন সন্তানের মা, একজন চিকিৎসক। আমি এদেশেরই লোক। দেশ এবং সমাজের প্রতি আমার যে দায়বদ্ধতা, সেখান থেকেই আমি মিডিয়ার সামনে সঠিক তথ্যটা তুলে ধরতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাহবুবা রহমান আঁখি আমার রোগী ছিলেন না। তিনি কুমিল্লার একটি স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসক দেখিয়েছেন। এ বছরের মার্চে তিনি দুই বার সেন্ট্রালে এসে আমাকে দেখিয়েছিলেন। নিয়মিত রোগী হতে হলে একজন গর্ভবতীর গর্ভাবস্থার শুরুতে প্রতি মাসে একবার এবং শেষের দিকে দুই সপ্তাহে একবার দেখাতে হয়। আঁখি আমার নিয়মিত রোগী ছিলেন না।
আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে ডা. সংযুক্তা সাহা বলেন, ‘কারও জন্যই এই অবহেলাজনিত মৃত্যু কাম্য নয়। এ সমস্যাকে এড়িয়ে না গিয়ে আমাদের প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের আড়াল করার সকল পথ অবলম্বন করছে। তারা দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে। সেন্ট্রাল হাসপাতাল নিজেদের দায় এড়াতে চাচ্ছে।’
সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত ঘটনা বলতে গেলে হাসপাতালের কথা বলতে হয়। এই হাসপাতালে ২০০৭ সাল থেকে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছি। দুঃখজনকভাবে হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তির সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রচলিত রোগীর ভর্তির নিয়মও তারা উপেক্ষা করছেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রচলিত প্র্যাকটিস অনুযায়ী কোনো চিকিৎসকের লিখিত বা মৌখিক সম্মতি ছাড়া তার অধীনে রোগী ভর্তি হয় না। অথচ মাহবুবা রহমান আঁখি ভর্তি করার সময় সেন্ট্রাল হাসপাতাল আমার কোনো ধরনের অনুমতি নেয়নি। আমার উপস্থিতির ব্যাপারে সেন্ট্রাল হাসপাতাল মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছে যে, আমি বাংলাদেশে আছি। অথচ আমি দেশেই ছিলাম না। এসব প্রমাণ স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সব দায়িত্বশীল মহলে পাঠিয়েছি।’
নিজের সুনাম ব্যবহারের অভিযোগ করে ডা. সংযুক্তা সাহা বলেন, ‘হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের এই ধরনের অপরাধমূলক আচরণ আমার সুনামকে বেআইনিভাবে ব্যবহার করে আর্থিক লাভের একটি জঘন্য কৌশল ছাড়া কিছুই নয়। এ ঘটনার আগ পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আমি ছিলাম গর্ব। আর এখন নিজেদের গাফিলতি লুকানোর জন্য তারা আমার নামে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। তারা বলছে আমি বেশি রোগী দেখি। অথচ তারা সব সময় বেশি রোগী দেখতে আমাকে উৎসাহিত করেছে। তারা আমার চেম্বারের পাশে ঘুমানোর জন্য বেডের ব্যবস্থাও করেছে।’
অন্যান্য অভিযোগের জবাবে ডা. সংযুক্তা বলেন, ‘ভিডিও কলে অপারেশন করার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে কখনোই এমন কাজ করিনি। আমি ওখানের একজন কনসালনেন্ট, আমার ওখানে কোনো মালিকানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমি আমার অধীনস্থ কাউকে নিয়োগ বা বহিষ্কার করতে পারি না। জড়িতরা যদি আমার নিয়োগ করা হয়ে থাকে তাহলে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কীভাবে বরখাস্ত করল? বরং সত্যি হলো, আমার রোগী বেশি থাকায় হাসপাতাল পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করা তিনজন রেজিস্ট্রার্ড দিয়েছিল। এটি রোগী ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনিয়ম সাম্রাজ্য রক্ষার ক্ষেত্রে সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়ে গেছি। আমাদের আন্দোলন ছিল অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান করব না, নরমাল ডেলিভারিতে উদ্বুদ্ধ করব। এটাই কি আমাদের অপরাধ?’
এ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনিয়মের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান ডা. সংযুক্তা সাহা।
এর আগে, পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, গত তিন মাস ধরে সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল বলেও জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। ফলে নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই সন্তান প্রসব সম্ভব বলে তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন ডা. সংযুক্তা সাহা।
পরবর্তীতে প্রসব ব্যথা ওঠায় গত ৯ জুন রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি করা হয় আঁখিকে। তখন ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না। তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) কাজ করছেন।
ভুক্তভোগীর স্বামী ইয়াকুব আলী জানান, তার স্ত্রীকে যখন ওটিতে ঢোকানো হয় এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা শুরু করা হয়, তখনও সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি না জানতে চাওয়া হয়। ওই সময়ও কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং তিনি তার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরে জানা যায় ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না এবং তারা রোগীর কোনোরকম চেক-আপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই আঁখি সেন্সলেস হয়ে যান। পরে শেষ পর্যন্ত তার কোনো ইমপ্রুভমেন্ট হয়নি। প্রথমে নবজাতক এবং পরে আঁখি নিজেও মারা যান।
ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় গত ১৫ জুন ধানমন্ডি থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র একটি মামলা দায়ের করেন ইয়াকুব আলী। মামলায় ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা, ডা. মুনা সাহা, ডা. মিলি, সহকারী জমির, এহসান ও হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজকে আসামি করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর গত ১৫ জুন রাতে ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা সাহাকে হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এদিকে চিকিৎসাজনিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি পরিদর্শন দল ওই হাসপাতাল পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনে আইসিইউতে রোগীর রাখার উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়া যায়নি। এজন্য পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওই হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষ বন্ধ করে দেওয়াসহ কয়েকদফা নির্দেশনা দেওয়া হয়।
১৮ জুন রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে মারা যান মাহবুবা রহমান আঁখি। হাসপাতালের পক্ষ থেকে জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, গত ১০ জুন বিকেল ৩টা ৩৯ মিনিটে মাহবুবা রহমান আঁখিকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে অচেতন অবস্থায় লাইফ সাপোর্টে অ্যাম্বুলেন্সে আনা হয়েছিল। তার প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ ও হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এরকমটি স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে।
রোগীর শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে চৌধুরী মেহের-এ-খোদা জানান, ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। রোগীর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয় এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা অব্যাহত ছিল।
ল্যাবএইডের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরও বলেন, রোগীর ইউরিন আউটপুট বন্ধ থাকায় ডায়ালাইসিস প্রদান করা হচ্ছিল। সকল প্রকার প্রচেষ্টার পরও রোগীর কোনো প্রকার উন্নতি হয়নি। আজ দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
গত ১৯ জুনের এ ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণার সম্পূর্ণ দায় ডা. সংযুক্তা সাহার ওপর চাপায়। সেই অভিযোগের জবাব দিতে আজ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ডা. সংযুক্তা সাহা।
সারাবাংলা/এসবি/এনএস