বাজেটে উপেক্ষিত জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার মানুষের জন্য উদ্যোগ
২২ জুন ২০২৩ ১৬:০০
ঢাকা: বাজেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ বাড়লেও প্রান্তজনসহ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বিপন্ন মানুষের জীবনমান বাড়াতে এবং পরিবেশ-সম্মত জীবন চলায় এই বাজেট কতটা সহায়ক হচ্ছে তার বিবৃতি নেই।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ২৫টি বিভাগের বাজেট বরাদ্দে পরিবেশ সংরক্ষণে কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে, তারও বিবরণ দেওয়া হচ্ছে। এসব পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগ হলেও এসব বরাদ্দ আখেরে কীভাবে, কতটা সত্যি খরচ হচ্ছে তার বিস্তারিত তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
বৃহস্পতিবার (২২ জুন) দুপুরে রাজধানীর পল্টনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে বাপা আয়োজিত ‘বাজেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু খাত: বরাদ্দ বিশ্লেষণ ও আগামীর পথনকশা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘দেশের মোট কার্বন নিঃসরণের ১৭ শতাংশই ইটভাটা থেকে আসে। তাই জল-জমি-বায়ু দূষণকারী এই প্রচলিত ইটভাটার বিকল্প হিসেবে কংক্রিট ব্লকের উৎপাদনে বিশেষ বরাদ্দ, ব্যবহারে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। ইটের ওপর ভ্যাটের পাশাপাশি বিশেষ ডিউটি আরোপ করতে হবে। এছাড়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর শিল্পকে নিরুৎসাহিত করে পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ।’
তিনি আরও বলেন, ‘জ্বালানিতেই সমাধান মিলবে- এ ধারণা ভুল। আমরা এখন ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো সক্ষমতা অর্জন করেছি। কিন্তু প্রাথমিক উপকরণের (গ্যাস ও তেল) অভাবে আমরা এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। আর আমাদের এখন চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এই চাহিদা মেটাতেও আমরা জ্বালানি উপকরণের ব্যাপক আমদানির উদ্যোগ নিচ্ছি। এ জন্য যে বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন হবে তার সংস্থান কতটা সম্ভব হবে তাও ভেবে দেখতে হবে। তাহলে আমরা পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের দিকে আরও জোরালো উদ্যোগ কেন নিচ্ছি না? বাংলাদেশ ২০২০ সালের মধ্যে মোট জ্বালানির ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। বাস্তবে এখনও আমরা মোট জ্বালানির মাত্র ২ শতাংশের বেশি সবুজ জ্বালানি উৎপাদন করতে পারছি না।’
সংবাদ সম্মেলনে বাপা আরও জানিয়েছে, এখন প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেশি জমির দরকারও হয় না। আর আমাদের ফ্যাক্টরি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদসহ যতগুলো কমিউনিটি স্থাপনা আছে সেসবের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করলে ৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা সংরক্ষণ করতে বেশি আগ্রহী। এ বিষয়ে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারটি প্ল্যান’, বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনাসহ অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমাদের হাতে রয়েছে। এসব পরিকল্পনার আলোকে আমরা সুনির্দিষ্ট প্রকল্প ও কর্মসূচিতে বিশ্ব জলবায়ু তহবিল ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে বাড়তি অর্থায়ন চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জলবায়ুর আঘাতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত এক দেশ। আমরা যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা করেছি তাতে আগামী ২৭ বছরে ২৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের দরকার হবে। আর তাপমাত্রা যদি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যায় তাহলে এর চেয়ে বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বেশকিছু প্রস্তাব করে বাপা। উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো হলো-
১। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ বরাদ্দ থেকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞানীরা যেন সহজে বাজেট পেতে পারে এজন্য জুরিবোর্ড গঠন করা ও টেকসই উন্নয়নে জলবায়ু অর্থায়ন’ প্রকাশনাটি অব্যাহত রাখা।
২। টেকসই নগরায়নের দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে। নগরের বাড়ির ছাদে নির্ভরযোগ্য সোলার প্যানেল স্থাপনে নেট মিটারিং ব্যবস্থায় সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের জন্য ২০-২৫ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে প্রতিটি ছাদে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগকে উৎসাহিত করা। সরকার, স্থানীয় সরকার ও নাগরিক সংগঠনগুলোর মাঝে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে আরও সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়ানো।
৩। সামগ্রিকভাবে কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন ব্যবস্থায় রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার উৎপাদনে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। কৃষিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে বিশেষ করে সোলার ইরিগেশন পাম্প বিনিয়োগে উৎসাহিত করা।
৪। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া। তামাক উৎপাদন ও বিপণনে নিরুৎসাহিত করার মতো বিশেষ শুল্ক-ভ্যাট, ট্যাক্স আরোপ করা।
৫। বায়ু দূষণ কমাতে নগরাঞ্চলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাজনিত সমস্যাগুলো দূর করতে হবে। পথেঘাটে পড়ে থাকা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে কর্তৃপক্ষগুলো কাজ করলে সুফল পাবে। যেমন এ কাজে প্রবীণ (অব) নাগরিকদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত করে সুফল পাচ্ছে জাপান। একাজে প্রবীনদের পাশাপাশি তরুণ শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে বিশেষ একটি প্রণোদনার ব্যবস্থা বাজেটে থাকতে পারে।
৬। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় ধুলোবালির কারণে বায়ু দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হন নগরবাসী ও গাছপালা। নগারবাসিকে ধুলোবালি থেকে রক্ষা করতে এ ধরনের কাজ দিনের পরিবর্তে রাতে হতে পারে। আর গাছগুলো সকাল বেলায়ই ধুয়ে দিলে পাতার ওপর পড়ে থাকা ধুলোর সমস্যা সমাধান সম্ভব।
৭। বায়ু দূষণের মাত্রা সম্পর্কে নীতি-নির্ধারকসহ সকলকে সংবেদনশীল করতে ওয়ার্ডভিত্তিক এয়ার কুয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) মাত্রা প্রতিদিন ডিজিটালি সকলকে জানানো গেলে সচেতনতা বাড়বে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক স্বেচ্ছাসবাভিত্তিক উদ্যোগের আগ্রহও তৈরি হবে।
৮। নগরে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বাঁচার তাগিদে আসা জলবায়ু শরণার্থীসহ যে প্রান্তজন কায়ক্লেশে জীবনযাপন করছেন, তাদের সন্তানদের জন্য কমিনিউটি ডে-কেয়ার সেন্টার, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধেসহ সামাজিক সুরক্ষা কি করে বাড়ানো যায় বাজেটে তার স্পষ্ট দিক নির্দেশনা থাকা উচিত।
সারাবাংলা/আরএফ/ইআ