।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: পাবলিক পরীক্ষাগুলোয় ধারাবাহিক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে কারণে চলমান উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে ব্যাপক কড়াকড়ির মধ্য দিয়ে।
এখন পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো অভিযোগ না উঠলেও শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অভিযোগ, পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে কড়াকড়ির নামে পরীক্ষার্থীদের ‘হয়রানি’ করা হয়েছে এ বছরের পরীক্ষায়। পরীক্ষাকেন্দ্রে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া নিয়ে বাড়তি কঠোরতা দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের। এ কারণে ফল বিপর্যয় হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। তবে নিয়মমাফিক পরীক্ষাকে স্বাভাবিক দাবি করে কেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো পরীক্ষার্থীকেই অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে না।
এবারের এইচএসসি পরীক্ষার শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সময় নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে পরীক্ষা কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সকাল ১০টার ৩০ মিনিট আগে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশের বিষয়ে বলা হলেও পরে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘোষণায় তা ২৫ মিনিট করা হয়।
যানজটের কারণে মাত্র তিন মিনিট দেরি হওয়ায় রাজধানীর এক কেন্দ্রে শিক্ষার্থীকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, যা এর আগে কখনও ঘটেনি। এ কারণে সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছাতে শিক্ষার্থীদের বাড়তি সময় হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়েছে। এটা নিয়ে চাপা দুশ্চিন্তাও ছিল পরীক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে।
রাজধানীর আফতাবনগরের ঢাকা ইমপেরিয়াল কলেজের কেন্দ্র পড়েছে বাসাবো এলাকার কদমতলা পূর্ব বাসাবো উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে পরীক্ষা দিচ্ছেন বাড্ডার আলী ইমতিয়াজ রিশাদ। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে তাকে বাসা থেকে বের হতে হয়।
রিশাদ সারাবাংলা’কে বলেন, ‘সিনিয়রদের কাছ থেকে পরীক্ষার হলের বিষয়ে যেসব কথা শুনেছি, তার কিছুই নেই হলে। নির্ধারিত সময়েরও অন্তত ২০ মিনিট আগে কেন্দ্র এলাকায় চলে আসি। পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষকরা অনেক কড়াকড়ি করেন। ঘাড় ফেরানো যায় না। একটু এদিক-সেদিক হলেই খাতা নিয়ে নেন স্যাররা।’
একই অভিযোগ রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী রাফসান জাকারিয়া রামীমের। তার অভিযোগ, কেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষকরা অকারণে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেন।
একই ধরনের অভিযোগ অভিভাবকদেরও। রাজধানীর ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এক পরীক্ষার্থীর বাবা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষার হলের নিয়ম-কানুন আছে। পরীক্ষার্থীদের সেগুলো মেনে চলতে হয়। কিন্তু নিয়ম মানতে গিয়ে কেন্দ্রগুলোতে দায়িত্বরত শিক্ষকরা অনেক বাড়াবাড়ি করেছেন বলে অভিযোগ করছে পরীক্ষার্থীরা। রীতিমতো হয়রানি করা হচ্ছে ওদের। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই যেভাবে আচরণ করা হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত।’ এতে করে ফল বিপর্যয় হলে সে দায় কার- এ প্রশ্ন রাখেন এই অভিভাবক।
আরেক অভিভাবক মুনমুন দাস মৌ-এর ছোট ভাই অংশ নিচ্ছে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায়। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা খুবই কড়াকড়ি করেছেন। পরীক্ষার্থীরা রীতিমতো মানসিক চাপে ভুগেছে। স্বস্তিতে পরীক্ষা দেওয়ার পরিবেশ ছিল না, এমন কথাও বলেছে তারা। তারা প্রস্তুতি অনুযায়ী পরীক্ষা দিতে পেরেছে কিনা- তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।’
তবে পূর্ব বাসাবো উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রের হল সুপার আব্দুর রাজ্জাক অযথা কড়াকড়ির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘পরীক্ষার হল বাসার পড়ার টেবিল না। এখানে কিছু আইন-কানুন থাকবে। সেগুলো মেনে চলাটাও এক ধরনের পরীক্ষা।’
এবারের পরীক্ষাকে স্বাভাবিক হিসেবে দাবি করে মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের প্রিন্সিপাল ড. শাহান আরা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রের ত্রুটি ধরা শিক্ষার্থীদের একটি সহজাত প্রবণতা। তারা অনৈতিক সুবিধা না পেলে এমন অভিযোগ করে। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। আমাদের যেসব শিক্ষক পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের কাছে এমন অভিযোগের কোনো সতত্যা পাইনি।’
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষায় কড়াকড়িতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে অনলাইনেও। সম্প্রতি এইচএসসি-২০১৮ ব্যাচের নামে বিটিআরসির ওয়েবসাইট হ্যাক করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরাবর একটি বার্তাও পাঠানো হয়েছে। তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে না পেরে পরীক্ষার হলে বাড়তি কড়াকড়ি আরোপের জন্য দায়ী করা হয় শিক্ষামন্ত্রীকে। এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ জানানো হয় ওই বার্তায়।
এতে বলা হয়েছে, ‘এইচএসসি-২০১৮ ব্যাচ এবার এক ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছে। এতদিন আপনার ইশারায় মানুষ জিপিএ ৫-এর খেলা দেখেছে আর এবার সেই আপনারই ইশারায় দেখবে ফেলের খেলা।’ এবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর মিষ্টির দোকানের বদলে কাফনের কাপড়ের দোকানে ভিড় বাড়বে বলেও উল্লেখ করা হয় ওই বার্তায়।
তবে ওই বার্তার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো পাল্টা জবাব কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেও এ বার্তায় তাদের সমর্থনের কথা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আফরাজুর রহমান সারাবাংলা’কে বলেন, ‘প্রতিদিন ফেসবুকে এমন অসংখ্য অভিযোগ করা হয়। সেগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলে নেওয়ার বিষয় নয়। শিক্ষাকে কতটা সহজ ও আনন্দময় করা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
পরীক্ষা হলে কড়াকড়ি আরোপ বিষয়ে আফরাজুর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষা হলে নির্ধারিত সময়েই আসতে হয়। এটা যেকোনো কাজের জন্যই আবশ্যক। জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্য বাড়তি চাপ দিয়ে অভিভাবকরাই তাদের সন্তানদের জীবন অতীষ্ঠ করে তুলছেন। জিপিএ ৫ পাওয়াকে তারা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়ে অযথা সন্তানদের জীবন বিষিয়ে তুলছেন।’ এ কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সে দায় অভিভাবকদেরই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ভীতি ছড়ানোর জন্য ফেসবুকে এমন বার্তা দেওয়া হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অপরাধতত্ত্ববিদ তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন বার্তা ছড়ানো শিক্ষার্থীদের মনোবৈকল্যের উদাহরণ। সন্তানের জিপিএ ৫ পাওয়া নিয়ে অভিভবিকদের অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা শিক্ষার্থীদের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ থেকে শিক্ষার্থীরা হয়তো এমন কথা ভেবে থাকতে পারে।’
সারাবাংলা/এমএস/টিআর