৭৪ বছরে আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক যারা
২৩ জুন ২০২৩ ০০:১০
ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭৪ বছর পূর্ণ করে পা দিল ৭৫ বছরে। পাকিস্তান নামক ঔপনিবেশিক ধরনের কৃত্রিম রাষ্ট্রের নিগড়ে বাধা বাঙালি একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভাষা-সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের জন্য ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে এই ভূ-খণ্ডে পাকিস্তানের কবর রচনা করে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি তাদের জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। এই সংগ্রাম ও যুদ্ধে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগের বিদ্রোহী প্রগতিশীল অংশের উদ্যোগে এক গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে এ দলটি আত্মপ্রকাশ করে। নতুন দলটির নামকরণ হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ’। ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দল হিসেবে প্রকৃত জাতীয় প্লাটফরম হিসেবে নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।
দলটির প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতারা। পরবর্তী সময়ে যুক্ত হন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এক পর্যায়ে তিনিই হয়ে ওঠেন দলের প্রধান নেতা। ষাটের দশকে এই দলটির নেতৃত্বে পাদপ্রদীপে আসেন প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম-সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলন, ’৫২-এর ভাষা সংগ্রাম, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা, ১৯৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের দাবি ৬-দফা উত্থাপন, আগরতলা মামলা মোকাবিলা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান, বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশের সংবিধান রচনা, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি, দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং র্যাডিকেল আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ ও রূপায়ণ প্রভৃতির প্রাণপুরুষ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তিনি পান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভেতর দিয়ে তিনি লাভ করেন ‘জাতির পিতা’র আসন। বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাসে তিনি খ্যাত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। তিনি আমাদের কাছে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। মানব ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের এক চরম ট্র্যাজেডির শিকার তিনি। ১৯৮১ সাল থেকে এই দলের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। গত ৪২ বছর ধরে তিনি এই দলের হাল ধরে আছেন। ১৯৭৫ সালের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন শেখ হাসিনা। নানা ষড়যন্ত্র, হত্যা-প্রচেষ্টা, উত্থান-পতনের পরম্পরায় ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। এরপর অনুষ্ঠিত হয়েছে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত এই দল টানা সাড়ে ১৪ বছর যাবত ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের এই গৌরবোজ্জ্বল অভিযাত্রায় গর্বিত সমগ্র বাঙালি জাতি।
আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের পথচলায় ২২তম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন।
পাকিস্তান আমল: আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে প্রথম জাতীয় সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পরে প্রতিনিধিদের সমর্থনে ৪০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৩ সালের দ্বিতীয় সম্মেলন সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আর দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাধারণ সম্পাদক পদটি পান শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর রূপমহল সিনেমা হলে দলের তৃতীয় সম্মেলনে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। এ সম্মেলনে পুনরায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৭ সালে চতুর্থ সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। ১৩ জুন আরমানিটোলার নিউ পিচকার হাউজে এবং পরদিন গুলিস্তান সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
দলের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। এ সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পুনরায় নির্বাচিত হন মাওলানা তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। আর প্রথমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ।
১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে আটক থাকাবস্থায় অনুষ্ঠিত হয় দলের সপ্তম জাতীয় সম্মেলন। ১৯ থেকে ২০ অক্টোবর হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭০ সালের উত্তাল সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের অষ্টম সম্মেলন। এ সম্মেলনের মাধ্যমে ছয় দফা ও ১১ দফা গ্রহণ করে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নেয় আওয়ামী লীগ। ৪ থেকে ৫ জুন হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালের ৭ থেকে ৮ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম এবং সব মিলিয়ে নবম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সার্কিট হাউজ রোডের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ১০ম জাতীয় সম্মেলন সার্কিট হাউজ রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা দলের পদে থাকতে পারবেন না। ফলে বঙ্গবন্ধু দলীয় সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সভাপতি হন এএইচএম কামারুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান।
এরপর ঘটে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নৃশংস ও ভয়াবহ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার অনুপস্থিতিতে চরম প্রতিকূল সময় ১৯৭৭ সালের ৩ থেকে ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে দলের ১১তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। এর পরের বছর ১৯৭৮ সালে ৩ থেকে ৫ মার্চ হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১২তম জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল মালেক এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুর রাজ্জাক।
১৯৮১ সালের ১৩তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাক দলত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নেতৃত্ব পাওয়ার পর দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
১৯৮৭ সালের ১ থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৪তম জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯২ সালের ১৯ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলের ১৫তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ দুই বছর থেকে বাড়িয়ে তিন বছর মেয়াদী করা হয়। এতে শেখ হাসিনা সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ১৬তম জাতীয় সম্মেলন ছিল আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ৬ থেকে ৭ মে আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও জিল্লুর রহমান। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে তখন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় দলের ১৭তম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুল জলিল।
২০০৯ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১৮তম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১৯তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর দুই দিনব্যাপী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০১৯ সালের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে পুনরায় শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২২তম জাতীয় সম্মেলনে ২০২২ সালে পুনরায় সভাপতি হিসাবে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচিত হন।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম