বাসে সিসি ক্যামেরা, সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত প্রকল্প
২৪ জুন ২০২৩ ২১:০১
ঢাকা: নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্যোগ নিয়েছিল নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা নেওয়া হয় গণপরিবহনে নজরদারির জন্য সিসি ক্যামেরা বসানোর। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন উঠেছে কতটা কার্যকরী হয়েছে এই উদ্যোগ। এই প্রকল্প নেওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ ও ভারতে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা।
ভারতের দিল্লিতে ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর চলন্ত বাসে ড্রাইভার, হেলপার ও যাত্রীসহ আটজনের হাতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ফিজিওথেরাপি ইন্টার্ন ‘নির্ভয়া’। নির্ভয়ার সঙ্গে থাকা তার ছেলে বন্ধুও মারাত্মক মারধরের শিকার হন। পরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নির্ভয়া। ঘটনাটি সারাবিশ্বেই প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। প্রশ্ন ওঠে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট একই ধরনের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশেও। টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাসে করে তিনি কর্মস্থল ময়মনসিংহে ফিরছিলেন।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালে ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় যাতায়াতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ২০১৮ সালেই অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ নারী বাস টার্মিনাল বা ট্রেন স্টেশনের মতো জায়গায় হয়রানির শিকার হন। রাস্তায় ৮০ শতাংশ আর স্কুল-কলেজের বাইরে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী হয়রানির শিকার হন।
একই বছর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত ১৩ মাসে গণপরিবহনে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২২টি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী গণপরিবহনের চালক-হেলপারসহ সহযোগীরা মিলে ৯টি গণধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৫টি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটায়।
এমন সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে গণপরিবহনে নজরদারির জন্য সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা করে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক অবস্থায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচশ’ বাসে সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই সংখ্যা একশ’তে নেমে আসে। বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দীপ্ত ফাউন্ডেশন।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিসি ক্যামেরা কেনায় অতিরিক্ত ব্যয়, সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে অভিনব এই প্রকল্প। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঠিক পরিকল্পনা ও তদারকির অভাব এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার অনভিজ্ঞতা, কারিগরী সহায়তা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত খরচের কারণে পাইলট প্রকল্প আর বাড়বে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
প্রকল্পটির পরিচালক পদে রয়েছেন উপ-সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা। প্রকল্প চলাকালে প্রকল্প পরিচালক বদলেছে তিনবার। বর্তমানে প্রকল্প পরিচালক দীপক কুমার রায় দায়িত্ব পেয়েছেন পাঁচ মাস আগে।
তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পে অনেক পরে যুক্ত হয়েছি। নিয়মিত প্রশিক্ষণ হচ্ছে। তবে মন্ত্রণালয়ে লোকবলের অভাবে ও বাসের রুট সচিবালয় থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দীপ্ত ফাউন্ডেশন থেকে প্রতিদিন দুইবার রিপোর্ট পাঠানো হয়। আমি নিজেও কয়েকবার সিএমসি পরিদর্শনে যেয়ে দেখেছি। এখন পর্যন্ত সিসি ক্যামেরা লাগানো বাসে বড় কোনো দুর্ঘটনার অভিযোগ পাওয়া যায়নি।’
এ বিষয়ে বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, ‘তারা ক্যামেরা লাগিয়ে গেছে। এগুলোর ফলোআপ বা মনিটরিং কে করবে তার কোনোকিছুই আর করা হয়নি। এভাবে ক্যামেরা লাগিয়ে কোনো সুফল আসেনি। একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির সবগুলো বাসে ক্যামেরা লাগালে ওই বাসে নারীরা বেশি উঠছে কি-না তা বোঝা যেত।’
ঢাকায় বাস চলাচল করে প্রায় পাঁচ হাজার। সবগুলো বা এর একটি বড় অংশ বাসেও যদি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয় তা বিশাল ব্যাপার। সেটিও সফল করা সম্ভব যদি সঠিক তদারকি করা যায়- মন্তব্য এনায়েত উল্ল্যাহর।
দীপ্ত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সারাবাংলাকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে মেয়েদের অবদান অনস্বীকার্য। আমরা চাই আমাদের মেয়েরা নিরাপদে গণপরিবহনে চলাচল করুক। সেই লক্ষ্যেই এই প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছিল। আমরা সার্বক্ষণিকভাবে বাসগুলো নজরদারিতে রাখছি এবং মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাই। যেহেতু এটি পাইলট প্রকল্প তাই অনভিজ্ঞতার জন্য আমরা কিছু কিছু জায়গা মিস করে গেছি। আশা করছি প্রকল্প বাড়লে এই ভুলগুলো ঠিক করে আরও কার্যকরীভাবে কাজটি করতে পারব।
প্রকল্পটি কতটুকু কার্যকর
বাস মালিক, ড্রাইভার, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে জানা যায় প্রকল্প বিষয়ে কারোরই সুস্পষ্ট কোনো মতামত বা ধারণা নেই। দীপ্ত ফাউন্ডেশনের দেওয়া রিপোর্টগুলো মন্ত্রণালয় যাচাই করে না বললেই চলে।
প্রকল্প পরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পেয়েছি পাঁচ মাসের মতো। এটি অনেক পুরনো প্রকল্প। লোকবল কম থাকায় তারা সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে পারছি না। এছাড়া মনিটরিং ও প্রচারের সুবিধার্থে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির বিভিন্ন রুটে চলমান সব বাসে দিলে ভালো হত। প্রকল্প যদি বাড়ানো হলে এসব দিক বিবেচনা করা হবে।’
বাসগুলোতে একটি করে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে যা ড্রাইভারের পেছনে, ওপরে। এতে ইঞ্জিনের পাশে ও ড্রাইভারের ঠিক পিছনের নারী সিটে বসা যাত্রীদের হয়রানির চিত্র স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাস্তবায়নকারী সংস্থা দীপ্ত ফাউন্ডেশন জানায়, তাদের লক্ষ্য ছিল, পাইলট প্রকল্প হিসেবে সাধারণ বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো যাতে নিত্যদিন চলাচলকারী যাত্রীরা নিরাপদে চলতে পারেন। শুধু ক্যামেরা নয়, ক্যামেরার নিরাপত্তার জন্য খাঁচা, সংযোগের জন্য ইউপিএস লাগাতে হয়েছে। এসব ‘লোকাল বাস’ এর অবস্থা সবসময় ভালো থাকে না। আবার একেক বাসের সিট বিন্যাস একেক রকম। ফলে সব বাসে একই জায়গায় বসানো যায়নি।
একদম পেছনে কেন বসানো হলো না এটি জানতে চাইলে দীপ্ত ফাউন্ডেশন জানায়, যেহেতু সামনের দিকে ইঞ্জিন ও ব্যাটারি থাকে তাই তারা সামনেই বসিয়েছেন। পেছনে বসালে ব্যাটারি সংযোগে সমস্যা হতে পারত। তাই সবদিক বিবেচনা করে এবং বাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ড্রাউভারের সিটের পেছনে এটি লাগিয়েছেন।
এ বিষয়ে গাবতলী এক্সপ্রেসের মালিক রুবেল মিয়ার প্রশ্ন, ‘বাসের পেছনে লাইট, ফ্যান চলতে পারলে ক্যামেরা কেন চলবে না?’
সারাবাংলা/আরএফ/রমু