আ.লীগে রহমানের পাল্লা ভারি, বিএনপি’র শাহ জাফর
২৫ জুন ২০২৩ ০৮:০০
ঢাকা: আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি ফরিদপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চান বেশ কয়েকজন নেতা। গত ১৪ বছরে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে— বিভিন্ন জনসভায় এমনটি দাবি করছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এমনকি দলীয় মনোনয়ন পেলে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তারা। আর বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী শ্রমিক নেতা শাহ মো. আবু জাফর তাকিয়ে আছেন দলীয় সিদ্ধান্তের দিকে।
আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী ও মধুখালী— এই তিন উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-১ আসন। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একটি উপনির্বাচনসহ মোট ১২ বার নির্বাচন হয়েছে এ আসনে। এর মধ্যে সাতবার জিতেছে আওয়ামী লীগ, দুইবার বিএনপি, দুইবার জাতীয় পার্টি এবং একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী এস এ মালেক। ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত হন বিএনপি প্রার্থী এবিএম গোলাম মোস্তফা, ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাহ মো. আবু জাফর।
স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসনে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর প্রয়াত মো. আব্দুর রউফ মিয়া (রউপ মাস্টার), ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আফসার উদ্দিনকে হারিয়ে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী খন্দকার নাসিরুল ইসলাম। পরে তিনি বিএনপি যোগ দেন। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী সিরাজুল ইসলাম।
২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজী সিরাজুল ইসলাম বিএনপিতে যোগ দেওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। ওই বছর আগস্টে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির প্রার্থী শাহ মো. আবু জাফর। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন তৎকালীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আব্দুর রহমান। ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন তিনি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মঞ্জুর হোসেন বুলবুল।
স্থানীয়রা বলছেন, গড়াই-মধুমতি নদী বিধৌত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ মধুখালী-বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা বরাবরই মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা স্বপক্ষ শক্তির উর্বর ভূমি। এ আসনের ১২টি নির্বাচনের মধ্যে যে দুইবার বিএনপি জিতেছে তার মধ্যে একটি ছিল জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে। অপরটি ছিল ২০০৫ সালের উপনির্বাচন, যেখানে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। এছাড়া ১৯৮৮ এবং ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনেও অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগ। ওই দু’টি একতরফা নির্বাচনের একটিতে জাতীয় পার্টি এবং অপরটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। অর্থাৎ এ আসনে নয় বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাত বার বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ।
সঙ্গত কারণেই এ আসনটিতে বরাবরই নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। নির্বাচনি হাওয়া শুরু হতে না হতেই নৌকার পাল তুলে দিয়েছে প্রায় এক ডজন আওয়ামী লীগ নেতা। বর্তমান সংসদ সদস্য মঞ্জুর হোসেন বুলবুলকে মনোনয়ন দৌড়ে পেছনে ফেলতে তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদে এ আসনে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে এর পেছনে বর্তমান সংসদ সদস্যের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। তিনি গত পাঁচ বছরে এলাকায় তেমন আসেননি। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে এমন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে হবে, যিনি মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতে পারবেন।
মধুখালী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘কালপোহা উচ্চ বিদ্যালয়’র বিদায়ী প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান সংসদ সদস্য মানুষ হিসেবে চমৎকার। সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। কিন্তু নেতা হিসেবে ততটা আলোচিত বা পরিচিত নন। বাগ্মিতায় অপারদর্শী সংসদ সদস্য মঞ্জুর হোসেন বুলবুল মানুষের সামনে কথা বলতে পারেন না। প্রয়োজনীয় কথাগুলো অন্যকে দিয়েই বলান। সবদিক বিবেচনায় আমাদের কাছে মনে হচ্ছে- এবার মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান।’
ফরিদপুর-১ নির্বাচনি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন টাঙিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন। সংসদ সদস্য মঞ্জুর হোসেন বুলবুল ছাড়াও এই দলে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাবেক সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলাম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সাংবাদিক আরিফুর রহমান দোলন, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি লিয়াকত শিকদার, কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দিলীপ রায়, বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন মুশা মিয়া, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃক প্রমুখ।
জানতে চাইলে আরিফুর রহমান দোলন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি কাজ করি মানুষের জন্য। কাজ করার জন্য আমাকে এমপি হতে হবে— বিষয়টি এরকম না। তবে রাজনীতি যেহেতু করি, নির্বাচন করার ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। দল মনোনয় দিলে জিতে আসার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।’
এ আসনে নৌকা প্রতীক পেলে বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয় পেলেই তো বিজয় নিশ্চিত— এ ধরনের মূল্যয়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অতীত ইতিহাস দিয়ে সবসময় সব কিছু হয় না। কারণ, ইতিহাস সৃষ্টি হয় ইতিহাসকে পেছনে ফেলার জন্য। মনোনয় যিনিই পান না কেন যোগ্যতা, সততা, জনপ্রিয়তা দিয়ে জিতে আসতে হবে।’
বিএনপির মনোনয় দৌড়ে এগিয়ে শাহ মো. আবু জাফর
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক দুই সংসদ সদস্য। তারা হলেন— বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহ মো. আবু জাফর ও জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খন্দকার নাসিরুল ইসলাম।
শাহ মো. আবু জাফর ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল এবং ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হন। নয় বার নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছয় বার পরাজিত হয়েছেন তিনি। এ আসনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার মতো শক্ত প্রার্থী শাহ মো. আবু জাফর ছাড়া বিএনপি আর কেউ নেই বলেই ধারণা এলাকাবাসীর।
দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহ মো. আবু জাফর সংসদীয় আসনের তিন উপজেলায় সক্রিয় রয়েছেন। আর বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে আবু জাফরের প্রতিদ্বন্দ্বী খন্দকার নাসিরুল ইসলামের কার্যক্রম বোয়ালমারীতে সীমাবদ্ধ। ফলে শাহ জাফরেই আস্থা রাখছে বিএনপি।
জানতে চাইলে ফরিদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মোদাররেছ আলী ইছা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা আন্দোলনে আছি। নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে যদি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দেয়, তখন দেখা যাবে কোনো আসনে কে প্রার্থী হবে। আপাতত সবাইকে আন্দোলনের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের ব্যাপারে নয়।’
নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত
এদিকে, গত তিনটা নির্বাচন জোটগতভাবে অংশ নেওয়ায় জামায়াত কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি। শেষ বারের মতো ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মধুখালী উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা মো. হাবিবুর রহমান এ আসনে দাড়িপাল্লা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেবার তিনি ১২ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়েছিলেন। এর আগে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি ২৩ হাজার ৭৯৬টি ভোট পান।
মধুখালীর সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকায় জামায়াতের রাজনীতি নেই বললেই চলে। নব্বইয়ের পর দুটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিন উপজেলায় সর্বসাকুল্যে আড়াই শতাংশ ভোটও পায়নি স্বাধীনতাবিরোধী এই দলটি। পরের নির্বাচনগুলোতে অংশ নেয়নি তারা। আগামী নির্বাচনেও তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত নয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামায়াতের সাবেক প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখন রাজনীতিতে সক্রিয় নই। সুতরাং রাজনীতি নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া বা বক্তব্য আমার কাছ থেকে পাবেন না।’
জাতীয় পার্টির খবর নেই
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৬-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল জাতীয় পার্টির। কিন্তু জাতীয় পার্টিস ছেড়ে শাহ মো. আবু জাফর বিএনপিতে যোগ দেওয়া পর ফরিদপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টি এবং লাঙ্গল অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে লাঙ্গল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মো. আকতারুজ্জামান খান ভোট পেয়েছিলেন ১ হাজার ১৭৭টি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. কামরুজ্জামান মৃধা দলীয় মনোনয় না পেয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রার্থী হন। ওই বছর তিনি ভোট পান ৬৬৯টি। এবার তার কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, এই আসেনে মোট ভোটার ৪ লাখ ২২ হাজার ৬৮৫। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩ লাখ ৪ হাজার ৬০৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগে মনোনীত প্রার্থী মঞ্জুর হোসেন বুলবুল। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী শাহ্ মো. আবু জাফর পান ১১ হাজার ৫০ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান। আর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মো. আব্দুর রহমান নৌকা প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮৭টি ভোট পেয়ে বিএনপির শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে প্রায় লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। সেবার শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পান ৭২ হাজার ৩৯৬ ভোট।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম
আব্দুর রহমান আরিফুর রহমান দোলন কাজী সিরাজুল ইসলাম খন্দকার নাসিরুল ইসলাম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফরিদপুর-১ আসন মঞ্জুর হোসেন বুলবুল শাহ মো. আবু জাফর